২১ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:১২

সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছেই

তফসিল ঘোষণার ১৩ দিন অতিবাহিত হলো। দেশের প্রধান দুই জোটে চলছে প্রার্থী চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু এখনো নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার চলছেই। এর থেকে বাদ যাচ্ছেন না শীর্ষ নেতারাও। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে একদিকে বলা হচ্ছে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন। আবার শীর্ষ নেতারাও এও বলেছেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আচরণের উপর নির্ভর করবে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই যখন অবস্থা তখন সাধারণ মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন- কী ঘটবে? নির্বাচন কি আদৌ হবে? ভোটাররা কি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন? একইসাথে সাধারণ মানুষ এই নিয়েও শঙ্কার মধ্যে আছেন যে, সরকার ও ইসি যেভাবে বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তাতে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি অস্বাভাবিকও হতে পারে।

সূত্র মতে, নির্বাচন নিয়ে কিছুদিন যাবৎ যে তর্কবিতর্ক, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, অনিশ্চয়তা চলছিল সেটা এখন দূর হয়েছে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর। কিন্তু তা সত্ত্বেও তর্কবিতর্ক, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির অবসান হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বিরোধী জোট যখন গায়েবি মামলা, নেতাকর্মীদের দমন পীড়নের কথা বলছে, তখন সরকারি দল বলছে এসব মিথ্যা। বিরোধী পক্ষ যখন নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ নিয়ে যাচ্ছে তখন ইসি বলছে, কিছুই করার নেই। অথচ নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করতে তারা বদ্ধপরিকর বলে ঘোষণা দিচ্ছে। আগামী নির্বাচন সম্পর্কে নিরপেক্ষতার ঘোষণা সত্ত্বেও সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালের নির্বাচনে যা করেছিল সেটা কারও ভোলার কথা নয়। মনে রাখা দরকার, যারা তখন সরকারি ক্ষমতায় ছিল তারা এখনও আছে। তাদের চরিত্র পরিবর্তন হয়েছে এটা ভাবার কারণ নেই। কাজেই সুযোগমতো তারা কারচুপির চেষ্টা যে চালিয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ আওয়ামী লীগের মধ্যে পরাজয়ের একটা আতঙ্ক ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে এবং তার প্রতিফলন হচ্ছে তাদের নানা অবাস্তব আস্ফালনের মধ্যে। এই আতঙ্ক বেশি করে দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে, যারা দীর্ঘদিন ধরে দেশের সম্পদ লুটপাট করেছে, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে, যারা গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে প্রায় খোলাখুলিভাবে বিভিন্ন নির্যাতন, গুম, মামলা, হয়রানি অতিরিক্ত করেছে শুধু বিরোধী দলের ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণ লোকদের বিরুদ্ধেও।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের শুধু সরকার আর বিরোধী দল নয়, নির্বাচন কমিশনের জন্যও মহাপরীক্ষা। সরকারের পরীক্ষার বিষয় হলো- সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ দেয়া এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য গণরায় অর্জন। বিরোধী দলের পরীক্ষা হলো- দেশে গণতন্ত্রের দ্বার উন্মুক্ত করে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। আর নির্বাচন কমিশনকে পরীক্ষা দিতে হবে- অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের সাহস ও যোগ্যতার প্রমাণ দেয়ার জন্য। এবার রিটার্নিং অফিসারদের সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘এই নির্বাচন হচ্ছে জনগণের কাছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার নির্বাচন।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পর্যন্ত বাস্তবে আমরা কী দেখছি? ১৪ নবেম্বর একটি পত্রিকার হেডিং : ‘ইসির নির্দেশ মানছে না জনপ্রশাসন’। ওদের খুঁটির জোর কী কারণে? এ অবস্থায় ইসি কিছু হাঁকডাক ছেড়ে বিনা অ্যাকশনে চুপ মেরে গেলে নির্বাচন প্রহসনে পর্যবসিত হতে পারে। অনেকেই সন্দিহান বিরাজমান পরিস্থিতি দেখে। সাবেক আ’লীগ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেছেন, সরকারি দল বুঁদ হয়ে থাকলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া আদৌ সম্ভব হবে না।
সূত্র মতে, শহর থেকে গ্রাম, পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত চারদিকে টেনশন, উদ্বেগ, আতংক- কী ঘটতে যাচ্ছে নির্বাচন নিয়ে। এমনকি বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরাও প্রতিনিয়ত দেশের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী কার্যক্রম শুরুও করে দিয়েছে, কিন্তু তারপরও সংশয় কাটছে না। সবার মনেই একই প্রশ্ন- নির্বাচন আদৌ হবে কী? কোন্ দিকে যাচ্ছে দেশ? সরকারি দল-বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। গত ১০ নবেম্বর বিরোধী দলগুলোর ঐক্যফ্রন্টও বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাবে। তবে এ সিদ্ধান্তে আদৌ তারা শেষ পর্যন্ত স্থির থাকবে কিনা কেউ বলতে পারছেন না। যেহেতু তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে এখন নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির গুরু দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপরই। নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত যা করেছে তাতে বিরোধীদল তো নয়ই, বুদ্দিজীবী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, এমনকি সাধারণ মানুষও এ কমিশনের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিরোধীদল নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলেও নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি না হলে তারা যে কোনো মুহূর্তে নির্বাচন বয়কট এবং এরসঙ্গে প্রতিরোধের ডাকও দিতে পারে। সেই পরিস্থিতি সরকার আদৌ মোকাবেলা করতে পারবে কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে খোদ সরকারের মধ্যেই। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক মহলও এ মুহূর্তে সরকারের কর্মকান্ডে অসন্তুষ্ট, কেউ কেউ ক্ষুব্ধও। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, বিরোধীদলের প্রস্তুতিও বেশ কৌশলী এবং সুপরিকল্পিত।
জানা গেছে, সব দল একসঙ্গে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করলেও বাতাসে কিন্তু ভিন্ন আওয়াজ বইছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও অনেকে ভেতরে ভেতরে আশংকা প্রকাশ করে বলছেন, নির্বাচন আদৌ হবে কি না। নির্বাচন না হলে কী হবে অথবা কীভাবে এ সংকটের সমাধান হবে সেকথাও কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। সংলাপ-আলোচনা ভেঙে যাওয়া এবং একতরফা তফসিল ঘোষণার পর সরকারি মহলে এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছিল যে, তারা বোধহয় পার পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিরোধীদল-ঐক্যফ্রন্টের সার্বিক কৌশলী এবং দৃঢ় ভূমিকায় সেই ক্ষণিকের স্বস্তিটা আবার যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের কপালে যেন ভাঁজ পড়েছে। আওয়ামী লীগ ইতিপূর্বে অনেকবার বলেছে, বিএনপির হাতে ক্ষমতা দেয়া যাবে না। অর্থাৎ বিএনপিকে কোনোক্রমেই নির্বাচিত হতে দেবে না আওয়ামী লীগ। কারণ তারা আশংকা করছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। অন্যদিকে, একই রকমের আশংকা করছে বিএনপি-জামায়াতও। তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ আরেকবার ক্ষমতা আসলে আরো বেশি মাত্রায় দমন-পীড়ন চালানো হবে। ফলে তারাও যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন তারা সেই প্রস্তুতিই নিয়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কেন্দ্রিক সব কিছু ঘটার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত মাসগুলোতে প্রশাসন নিজেদের মতো করে সাজিয়েছে। যাতে নির্বাচনে তারা একচেটিয়া সুবিধা আদায় করতে পারে। সেই সাজানো অবস্থায়ই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। গত দশ বছরে সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণের যে চরম নৈরাজ্য চলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে অবস্থা যাই হোক না কেন বিএনপি তাদেও র্তণমুলে কিছু বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। ধানের শীষের কাণ্ডারি কারা হচ্ছেন, সেটা নিশ্চিত না হলেও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অন্তত ৫টি বার্তা দিচ্ছে বিএনপির হাই-কমান্ড। এর মধ্যে সবচেয়ে জোরালো বার্তা দেয়া হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকা এবং বিদ্রোহী হলে ব্যবস্থার বিষয়ে। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা জানান, এবার কেন্দ্র থেকে স্পষ্ট বার্তা সরকারি দলকে ফাঁকা মাঠে খেলতে দেয়া যাবে না। বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট বলছেন, এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সারা দেশে আলোড়ন ফেলেছে। জনমত ধানের শীষের পক্ষে। সুতরাং ভোটের দিন হাল ছাড়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে ভোট কেন্দ্র পাহারা দিতে হবে। ভোটের দিন যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যও প্রস্তুতি রাখতে হবে। যাকেই দল মনোনীত করবে, তার পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করার নির্দেশনা দিচ্ছে। হোক তিনি বিএনপি কিংবা জোটের প্রার্থী, সবাই তাকে জয়ী করার জন্য কাজ করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/354247