২১ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:১০

খেলতে হবে সমান মাঠেই

তৃতীয় নয়ন

মীযানুল করীম

আসন্ন সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের শুধু সরকার আর বিরোধী দল নয়, নির্বাচন কমিশনের জন্যও মহাপরীক্ষা। সরকারের পরীক্ষার বিষয় হলোÑ সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ দেয়া এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য গণরায় অর্জন। বিরোধী দলের পরীক্ষা হলোÑ দেশে গণতন্ত্রের দ্বার উন্মুক্ত করে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। আর নির্বাচন কমিশনকে পরীক্ষা দিতে হবেÑ অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের সাহস ও যোগ্যতার প্রমাণ দেয়ার জন্য। এবার রিটার্নিং অফিসারদের সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘এই নির্বাচন হচ্ছে জনগণের কাছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার নির্বাচন।’ যিনিই হোন না কেন, কারো অন্যায় চাপে নতি স্বীকার না করতে তিনি রিটার্নিং অফিসারদের প্রতি আহ্বান জানালেন। বিতর্কিত সিইসি এতটা সাহসী বক্তব্য না দিলেও তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপরই জোর দিয়েছেন। এখন কথা ও কাজে মিল থাকলেই হয়।

আমাদের দেশে বেশির ভাগ সময় (সামরিক-বেসামরিক সরকার নির্বিশেষে) নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন, নতজানু ও দায়সারা গোছের দেখে এসেছে দেশবাসী। গত এক দশকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অযোগ্যতা, অসহায়ত্ব, ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতা সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে জনগণকে আশ্বস্ত করাই শুধু নয়, তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে ইসিকে। সংবিধান যতটা ক্ষমতা দিয়েছে তাদের, অন্তত এর যথার্থ প্রয়োগ অপরিহার্য। অন্যথায় তাদের সাক্ষীগোপাল ভূমিকাকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

খেলার মাঠে খাদখন্দ
নির্বাচনী খেলার মাঠ কি সমতল হবে, নাকি উঁচু-নিচু খাদখন্দে ভরপুর থাকবে, এটা নির্ভর করে ইসি, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের ওপর। শুধু ক্ষমতাসীন দলের কাছে ময়দান লেভেল বা সমান মনে হলে চলবে না। এখানে নির্বাচনরূপী খেলায় যত টিম বা পক্ষ আছে, সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যÑ এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য ক্ষমতাবান না ক্ষমতাহীন, ভিআইপি না অর্ডিনারি, অমুক মার্কা না তমুক মার্কাÑ এসব মোটেও বিবেচনা না করে সব দল, জোট, প্রার্থী ও প্রতীকের জন্য হুবহু একই সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের গ্যারান্টি দিতে হবে ইসিকেই। এ জন্য ইসি প্রয়োজনে hire and fire করবে; প্রশাসনকে তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে বাধ্য করবে সাংবিধানিক ক্ষমতার বলে।
এ পর্যন্ত বাস্তবে আমরা কী দেখছি? ১৪ নভেম্বর একটি পত্রিকার হেডিং : ‘ইসির নির্দেশ মানছে না জনপ্রশাসন’। ওদের খুঁটির জোর কী কারণে? এ অবস্থায় ইসি কিছু হাঁকডাক ছেড়ে বিনা অ্যাকশনে চুপ মেরে গেলে নির্বাচন প্রহসনে পর্যবসিত হতে পারে। ইংরেজি পত্রিকার খবর, ROs in dilemma. এতে বলা হয়েছে, এবার নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর এমপি-মিনিস্টারদের তৎপরতার মোকাবেলা করা নিয়ে রিটার্নিং অফিসাররা উভয় সঙ্কটে পড়েছেন। এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ইসি ঢিমেতালে চললেও বেগম জিয়ার মনোনয়নপত্র যাতে গৃহীত না হয়, তার সুযোগ করে দিতে ইসি বিলম্ব করেনি বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ১৪ নভেম্বর পত্রিকার পয়লা পাতার শিরোনাম : EC asks ROs to cancel khaleda's nomination if conviction not stayed. এ দিকে, একই দিন রাজধানীতে বিএনপি অফিসের সামনে দলের কর্মীবাহিনী আর পুলিশের মধ্যে যে সহিংস ঘটনা ঘটে গেল, এ জন্য ইসির একটি ‘অপরিণামদর্শী’ চিঠিকে দায়ী করা হয়েছে। সরকার-সমর্থক একটি দৈনিক পরদিন লিড নিউজে হেডিং দিয়েছেÑ ‘ইসির অপরিণামদর্শী চিঠি/ নয়াপল্টন রণক্ষেত্র আগুন, ভাঙচুর, গুলি ১৯ পুলিশসহ অর্ধশত আহত’। যদি ইসির ভূমিকা এমন ন্যক্কারজনক হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’। হতাশ ও বিক্ষুব্ধচিত্তে অনেকে হয়তো বলবেন, ‘বুঝহ সুজন, যেজন জানহ সন্ধান।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি শুধু কমিশনের প্রধান নন, তিনিই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সর্বাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি। তিনি অবশ্য একটি ‘ঐতিহাসিক’ বক্তব্য দিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করা গেলে তাকে জাতি স্মরণে রাখবে বৈকি। তিনি বলেছেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনেও যে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, তা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেছেন।’ এটা বাত কি বাত (কথার কথা), ফাঁকা বুলি, না সত্যিই তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখার মতো দৃঢ়তা দেখাবেন, তা সামনের দিনগুলোতে প্রমাণিত হবে।

তবে অনেকেই সন্দিহান বিরাজমান পরিস্থিতি দেখে। ছাত্রলীগের বহুলপরিচিত সাবেক সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার নেতার একজন, মুজিব আমলের এমপি এবং আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী তাদের একজন। তিনি একটি পত্রিকায় লিখেছেন ‘সিইসি’র ওই বক্তব্য প্রসঙ্গে। তার ভাষায়Ñ ‘এ ক্ষেত্রে মানসিকতাটা মহৎ, কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত দুরূহ। যেখানে প্রশাসনের ডিসি-এসপিরা নিজেদের আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে উদগ্রীব, এমনকি প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে তার অতীত জীবনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ করার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন, সেখানে নির্বাচন কমিশনারের এ ধরনের দুঃসাহসিক আকাক্সক্ষা কল্পনাবিলাসী অবান্তর ও অবাস্তব বলেই জনগণ মনে করে।’

নূরে আলম সিদ্দিকী অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক মহল ও বিশ্বজনমতের দৃঢ় অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ইসির সাফল্য যে অনেকটা সরকারের বাঞ্ছিত সহায়তার ওপর নির্ভর করে, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকাÑ এই মানসিকতায় সরকারি দল বুঁদ হয়ে থাকলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া আদৌ সম্ভব হবে না।’
নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন Level Playing Field কথাটা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত ও আলোচিত। সবার জানা কথা, খেলার মাঠ, সেখানে খেলায় অংশ নেয়া সবার জন্য একই রকম হতে হয়। কেবল দু-একটি টিমের কাছে এটা গ্রহণীয় হলে চলে না। অপর দিকে, খেলোয়াড় যত দক্ষ ও অভিজ্ঞ হোন না কেন এবং তিনি যত দীর্ঘ অনুশীলন করুন না কেন, মাঠ যদি খেলার উপযোগী না হয়, মাঠে যদি থাকে গর্ত আর আগাছা, এর অবস্থা যদি হয় কাদায় ভরা কিংবা এবড়োখেবড়ো, তাহলে সেই খেলোয়াড়ের পক্ষে ভালো খেলা মোটেও সম্ভব নয়। তখন তিনি খেলায় প্রত্যাশিত বা স্বাভাবিক সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হবেন। তাদের টিমের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। নির্বাচন একটা রাজনৈতিক খেলা। এ ক্ষেত্রেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠ হতে হবে সমতল ও বৈষম্যমুক্ত। অন্যথায় নির্বাচন হবে না গণতান্ত্রিক তথা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক।

প্রচারের জয়ঢাক ও রাজনীতির হিসাব
প্রচার-প্রপাগান্ডায় আওয়ামী লীগ বরাবরই পারদর্শী। এই দলের নেটওয়ার্ক যেমন বিশাল, তেমনি এর লোকজন স্বভাবগতভাবেই মুখচালু বা মুখর বেশি। প্রতিপক্ষের কাছে ‘গালাগালি’ কিংবা নিরপেক্ষর কাছে ‘গলাবাজি’ মনে হলেও দলটির নেতাকর্মীরা এর তোয়াক্কা না করে নিজেদের কথা সমানে বলে যান। একটা কথা বাংলাদেশে চালু আছে বড় তিন দল সম্পর্কে। তা হলো, ‘কোনো জায়গাতে আওয়ামী লীগের ১০ জন সমর্থক থাকলে তারা ১০০ জনের মতো আওয়াজ দেন। বিএনপির ১০ জন থাকলে তারা ১০ জনের মতোই সরব থাকেন। আর জামায়াতে ইসলামীর ১০ জন সাপোর্টার থাকলেও তাদের বাহ্যিক সাড়াশব্দ এত কম থাকে যে, মনে হয় দলটির সমর্থক সেখানে বড়জোর একজন।’

আওয়ামী লীগ তার ঐতিহ্যবাহী বাকপটুতা ও বাগ্মিতা এবং বিরাজমান সরকারি আনুকূল্যের সহযোগে নানাভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই, গত ১০ বছরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করা। এ জন্য প্রকাশ্যে তারা ‘শেখ হাসিনার সরকার আরেকবার দরকার’ বললেও, নেপথ্যে মনোবাসনা হলো আপাতত ২০৪১ সাল নাগাদ রাষ্ট্র চালনার রশিটা হাতছাড়া যাতে না হয়। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, ’২১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী, ২০২৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের অর্ধশতপূর্তি প্রভৃতি পালন বা স্মরণ আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতায় থেকেই এসব উপলক্ষ উদযাপন করতে চায় দলটি। অন্যথায়, এগুলো অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়বে। তা ছাড়া, দলের বর্তমান প্রধানের বয়স ৮০ বছর পূর্ণ হবে ২০২৭ সালে এবং এর আগে ২০২২ সালে পূর্ণ হবে ৭৫ বছর বা প্লাটিনাম জুবিলি। এটাও তারা বিবেচনায় রাখা স্বাভাবিক।

আওয়ামী লীগ যেভাবে হোক, নির্বাচনে যেমন এগিয়ে থাকতে চায়, তেমনি চায় রাজপথ দখলে রাখতে। বাংলাদেশে যারা আন্দোলনে বিজয়ী, তারাই ব্যালট যুদ্ধে কামিয়াব হয়Ñ এ কথা তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। এ জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যত উপায়ে সম্ভব, যথাসাধ্য ঠেকিয়ে ও কোণঠাসা করে রেখে, নিজেরা যত তাড়াতাড়ি পারা যায়Ñ প্রচার ও জনসংযোগ, দল ও প্রশাসন সাজানোসহ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখাই আওয়ামী লীগের কৌশল বলে জনগণের কাছে প্রতীয়মান।

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/366256