২০ নভেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:২৬

অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কি আন্দোলন প্রয়োজন?

নির্বাচন কমিশনার মিসেস কবিতা খানম প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব নুরুল হুদার একটি পুরাতন কথা নতুন করে বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, ‘পৃথিবীর কোথাও শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, বাংলাদেশেও হবে না’। কয়েক মাস আগে জনাব নুরুল হুদাও অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছেন যে, ‘তিনি শতভাগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি দিতে পারেন না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তারই সহকর্মী নির্বাচন কমিশনারের এসব মন্তব্যে দেশবাসী উৎকণ্ঠা বোধ করছে। কেননা, তাঁরা উভয়েই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের শপথ নিয়েই তাদের পদ গ্রহণ করেছেন। তাদের পদ সাংবিধানিক পদ; এখন তারা যেসব কথা বলছেন এগুলো শপথের লঙ্ঘন ছাড়াও সংবিধানেরও লঙ্ঘন। শপথ ও সংবিধান লঙ্ঘন করে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ পদে বহাল থাকতে পারেন কিনা জাতি তা জানতে চায়। তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় পরিচালিত হবার কথা; এ কথাটি যেমন সরকার বলছেন তেমনি নির্বাচন কমিশনও বলছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের আচার-আচরণ এবং সিভিল প্রশাসনের গতিবিধি থেকে তা বুঝা যাচ্ছে না। সম্প্রতি শাসকদল আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিস থেকে জাতীয় সংসদের দলীয় মনোনয়নপত্র বিতরণ ও বিক্রয় উপলক্ষে প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এলাকার রাস্তাঘাট ও অলিগলি বন্ধ করে সেখানে হাট বসেছিল। মনোনয়ন প্রার্থীদের সমর্থক-শুভাকাক্সক্ষীদের মিছিল স্লোগানে এলাকাটি মুখরিত ছিল। গাড়ি-ঘোড়া এমনকি সাধারণ মানুষের চলাচলও এসব রাস্তা দিয়ে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। পুলিশ তাদের কোন বাধা দেয়নি। নির্বাচন কমিশনও কোন আপত্তি করেনি। পক্ষান্তরে, বিএনপির নয়া পল্টন অফিস থেকে ফরম বিক্রির সময় যখন দেখা গেল, লক্ষ লক্ষ লোক মনোনয়নপত্র সংগ্রহের জন্য আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও মিছিল স্লোগান দিয়ে পুরো এলাকা মুখরিত করে তুলছে তখন হঠাৎ করে হেলমেট বাহিনী বলে কথিত একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট কিছু সদস্যের সহযোগিতায় একটি সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করে এবং গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বিএনপির সর্বোচ্চ মহল থেকে এর প্রতিবাদ করা হয় এবং ঘটনার জন্য ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের অঙ্গসংগঠনকে দায়ী করা হয়। কিন্তু সরকার কোন প্রকার তদন্ত না করেই বিএনপি নেতাদের এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করেন এবং গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেন। এখানে অনেকেই বলছেন, বিএনপি অফিসকে ঘিরে ঐ সময়ে যে জনসমাবেশ হয়েছিল তা ছিল আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিস থেকে নমিনেশন পেপার বিক্রির প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত সমাবেশের প্রায় দশ গুণ বড়। ক্ষমতাসীন দল তা সহ্য করতে পারেনি এবং সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে তা ভ-ুল করে দেয় ও তারা যাতে সামনের দিকে এগুতে না পারে তার ব্যবস্থা নেয়। অভিযোগটি গুরুতর। নির্বাচন কমিশন এই ব্যাপারে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। অবশ্য গ্রেফতার, রিমান্ডের পর নির্বাচন কমিশন পল্টনের ঘটনার রিপোর্ট চেয়ে পুলিশের কাছে একটি রিপোর্ট চেয়েছে। বিষয়টি হাস্যকর।

জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে নির্বাচনী প্রচারণার কিছু নিয়ম-কানুন বিধৃত আছে। এই বিধি-বিধানগুলো মেনে চলা সকলের জন্য অবশ্য কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারী দল প্রকাশ্যে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করে সরকারী অর্থ ব্যয় করে দলীয় প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। এমনকি তফসীল ঘোষণার অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিশ্চুপ। কয়েকদিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর একটি ডকুমেন্টারীও দেশের বিভিন্ন সিনেমা হলে প্রদর্শিত হচ্ছে। সারাদেশ সরকারী দলের প্রার্থীদের ব্যানার ফেস্টুন ও রঙিন ছবিতে ছেয়ে গেছে। বিরোধী দল কিছুই করতে পারছে না। তারা মিটিং সমাবেশ করতে গেলে গাড়ি ঘোড়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ব্লক রেইড করে জেলা উপজেলায় প্রতিদিন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে সরকারের প্রতিপক্ষ দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এখানে কোথায়? তারা ১০০% সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন না, নিরপেক্ষতাও দেখাতে পারবেননা, প্রশাসনকে তাদের কথা শুনানোর পদক্ষেপও নিবেন না। তাহলে তাদের প্রয়োজন কি?
কয়েকদিন আগে দৈনিক প্রথম আলো ব্যানার হেডিংয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে। খবরটি বিব্রতকর এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক। এতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে টেলিফোনে নির্বাচন কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী তা জানতে চেয়েছে পুলিশ। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, জেলা-উপজেলা তথা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় কর্মরত সরকারী, বেসরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্কুল-কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাই নির্বাচনকালে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে পুলিশের কোন ভূমিকা নেই; অথচ দেখা যাচ্ছে যে, পুলিশ কর্মকর্তারা উপরোক্ত নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এবং তাদের পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাচ্ছেন যা তাদের এখতিয়ারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর উদ্দেশ্য কী? এর উদ্দেশ্য নির্বাচনকে প্রভাবিতকরণ এবং তারা যদি আওয়ামীলীগে বিশ্বাসী না হয় তাহলে তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, হামলা-মামলা দিয়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা এবং আওয়ামীপন্থীদের দ্বারা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করা। এ অবস্থা চলতে পারে না।

গত ১০ বছরে ভারত বাংলাদেশে যত দালাল তৈরি করেছে এবং সরকারী ও বেসরকারী খাতে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে তাতে হয়ত তাদের প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন নেই। যা তারা করবে দালালদের মাধ্যমেই তা করবে। জনগণকেই পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা এদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন চান তাদের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের পুন:প্রতিষ্ঠা, বেগম জিয়াসহ রাজবন্দীদের মুক্তি, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংস্কার, রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ, ভোটার তালিকা সংশোধন ও ভুয়া ভোটারমুক্তকরণ এবং সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বিরোধীদল নির্যাতনের অবসান এই ন্যূনতম দাবীগুলো মেনে নেয়া না হলে এই দেশে নির্বাচনী পরিবেশ ফিরে আসতে পারে না। সরকার এই দাবীগুলোর প্রত্যেকটিই প্রত্যাখ্যান করেছেন। সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ বা বিদেশী কোন রাষ্ট্র এখানে ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মনে হয় না। তারা যা করতে পারেন তা হচ্ছে নৈতিক চাপ। কিন্তু শেখ হাসিনা এই চাপের তোয়াক্কা করেন না। এই অবস্থায় বিরোধীদলগুলো যদি সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং তারা যদি দুর্বার আন্দোলন করতে পারে তাহলেই সংকটের সমাধান সম্ভব। বিরোধী দল যদি নিজেদের মধ্যেকার সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এবং বিভিন্ন প্ররোচনা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে মাঠে নামতে পারে তাহলেই শুধু একটি দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। আন্দোলন ছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষা নির্বাচন আদায় সম্ভব হবে না বলে দেশবাসী বিশ্বাস করে। সরকার তার ক্ষমতা ও দু:শাসন টিকিয়ে রাখার যে অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে ঐক্যবদ্ধ জোরালো, সাহসী, আপোসহীন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছাড়া দেশকে তা থেকে মুক্ত করা যাবে না।

http://www.dailysangram.com/post/354132