১৮ নভেম্বর ২০১৮, রবিবার, ৯:৩৬

নির্বাচনী ব্যয়ে কালো টাকার বিস্তার

মনোনয়ন পেতেই বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছেন প্রার্থীরা * ভোটার প্রতি ব্যয়সীমা ৮ টাকা একজন প্রার্থীর সর্বোচ্চ ২৫ লাখ * নির্বাচনী অর্থনীতির আকার ১২ হাজার কোটি টাকা

দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থীর ক্ষেত্রে যে ব্যয়সীমা দেয়া আছে, ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্যও তারচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেন। নিয়ম অনুসারে একজন প্রার্থী ভোটার প্রতি সর্বোচ্চ ৮ টাকা ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু কোনো কোনো এলাকায় ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। ফলে নির্বাচনে ব্যয় সীমা একটি হাস্যকর বিষয়। কোনো প্রার্থীই এটি মানছেন না। তবে কাগজে-কলমে প্রার্থীরা সীমার মধ্যেই ব্যয় দেখাচ্ছেন। বাকি অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় বা কালো টাকা। অর্থনীতির আকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই নির্বাচনে কালো টাকার বিস্তার বাড়ছে।
নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থীরা আগে থেকেই টাকা সংগ্রহ শুরু করেন। যার বেশিরভাগই কালো টাকা। এভাবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কালো টাকার বিস্তার ঘটছে।

দেশের নির্বাচনে কী পরিমাণ ব্যয় হয়, সে ব্যাপারে সরকারি কোনো গবেষণা নেই। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, নির্বাচনী অর্থনীতির আকার ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতি নির্বাচনেই এ হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে। মনোনয়ন পাওয়ার আগেই বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেন প্রার্থীরা। মনোনয়ন পেতে প্রকাশ্য ও গোপনে নানা ধরনের তৎপরতা চলে। এক্ষেত্রে দলের শীর্ষ পর্যায়ে দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি বা দলীয় পরিসরে অর্থায়ন। এছাড়াও ক্লাব, সমিতি, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দিতে হচ্ছে অর্থ। এক্ষেত্রে প্রার্থীর পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে দলীয় পদ পেতে আগ্রহীরাও ব্যয় করছেন বড় অঙ্কের অর্থ। সবকিছু মিলে নির্বাচনকে ঘিরে বাজারে বিশাল অঙ্কের টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এর প্রায় সবই কালো টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের ব্যয় সীমার মধ্যে রাখতে অডিট পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
জানতে চাইলে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে না পারলে সৎ ও যোগ্যপ্রার্থী আসবে না। এতে সুশাসন ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তারমতে, ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত এগুলোর পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ আবশ্যক। এজন্য অডিটর নিয়োগ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ, কর্নাটক ও সিকিমের প্রাদেশিক নির্বাচনকালে প্রার্থীদের দৈনন্দিন নির্বাচনী ব্যয় তদারকির লক্ষ্যে টিএন সেশনের নেতৃত্বে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এমনইভাবে অডিটর নিয়োগ করেছিল।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ৪৪বি (৩এ) উপধারা অনুসারে বর্তমানে ভোটার প্রতি প্রার্থীদের ব্যয় ৮ টাকা। তবে একটি আসনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে পারবেন না। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত ব্যয়ের সীমা প্রার্থীরা মানেন না। ভোটার প্রতি প্রার্থীরা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে থাকেন। সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সম্ভাব্য নির্বাচনী ব্যয়ের উৎসের একটি বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক। নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব তফসিলি ব্যাংকে সংরক্ষণ করাও আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। নির্বাচনের ফল ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্ধারিত ফরমে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করতে হয়। আর এসব বিষয় শুধু আইনেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এটি কেউ মেনে চলেন না। ঘোষণায় যে অর্থ ব্যয় হয় সেগুলোই সাদা টাকা। এর বাইরে প্রায় সবই কালো টাকা।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ভোটার প্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ৮ টাকা। প্রতি আসনে ১০ জন করে প্রার্থী হলেও মোট নির্বাচনী ব্যয় হওয়া উচিত ৯০০ কোটি টাকার মধ্যে। কোনোভাবেই তা হাজার কোটি টাকার বাইরে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে নির্বাচনী অর্থনীতির আকার ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক্ষেত্রে সব প্রার্থী সমানভাবে ব্যয় করতে পারেন না। ফলে বড় দুই জোটের প্রার্থীরা বড় অঙ্কের ব্যয় করে থাকেন। তারা কেউ কেউ ২৫ লাখের পরিবর্তে ২৫ কোটি টাকাও ব্যয় করে থাকেন। খুব সীমিত সময়ে এ অর্থ ব্যয় হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতিতেও এর প্রভাব পড়ে। নির্বাচন শেষে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় ভোটারদের নিয়ে সারা দেশে প্রার্থীদের মধ্যে তৎপরতা চলছে। এসব কাজে প্রার্থীরা এখন পানির মতো টাকা খরচ করছেন। এসব ব্যয়ের বড় অংশই কালো টাকা। আর যারা নির্বাচন করবেন, তারা দীর্ঘদিন থেকে টাকা সংগ্রহের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চোরাকারবারি, নামে-বেনামে ব্যাংক ঋণ এবং শেয়ারবাজারকে টাকা আয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ৮ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এ ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বা ঋণ বিনিয়োগ করে অর্জিত আয়ের একটি বড় অংশ নির্বাচনে ব্যবহার হবে। ৫৭টি ব্যাংকের সারা দেশে ৮ হাজার ৮৪৯টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ শাখা ৫ হাজার ৪৯টি। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে শহুরে শাখার চেয়ে গ্রামীণ শাখাই বেশি। এসব ব্যাংক থেকে ঋণের টাকাও নির্বাচনে ব্যয় হয়। তবে এ ঋণের মধ্যে খেলাপি এবং অবলোপন মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। যদিও ঋণ খেলাপিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই; কিন্তু কৌশলে তারা খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে প্রার্থী হচ্ছে। আর এ ঋণের টাকাই নির্বাচনে খরচ করছে। অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এছাড়াও বিদেশ থেকে রেমিটেন্স এসেছে দেড় হাজার কোটি ডলার। এছাড়াও চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর আগে গত ৫ বছরে বিশাল অঙ্কের উন্নয়ন ব্যয় ছিল। নানা মাধ্যমে এর একটি অংশ নির্বাচনে ব্যয় হবে। ব্যয়ের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে প্রার্থীদের ব্যয়ের বড় অংশ খাদ্য খাতে যেত। বর্তমানে নগদ টাকার বিতরণ বেড়েছে। এছাড়া এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভোটারদের অর্থ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন নির্বাচনী আইনে সংস্কার আনার পাশাপাশি প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় সীমা নির্ধারণ করে। ওই সময়ে একজন প্রার্থী ব্যয় করতেন সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা। আর ভোটার প্রতি ব্যয় নির্ধারণ ছিল ৫ টাকা। এর আগে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় সীমা নির্দিষ্ট ছিল না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/112879