১৮ নভেম্বর ২০১৮, রবিবার, ৯:২৭

তফসিল ঘোষণার ১০ দিনেও নির্বাচন কমিশনের আওয়ামী রোগ সারেনি

গণতন্ত্রের স্বার্থে, বাক-স্বাধীনতার স্বার্থে, মতামত প্রকাশের স্বার্থে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে অনেক ছাড় দিয়ে বিএনপি, ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো সময় চায়নি, বিএনপি তথা বিরোধীদলীয় জোটসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনে তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছিলো। এবারো তারা সেটাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বারবার ঘোষণা করেছেন যে তারা এবার আওয়ামী লীগকে ওয়াক ওভার দেবেন না। সেই ঘোষণা মোতাবেক ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।

বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের এই সিদ্ধান্তের ফলে আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়েছে। না পারছে তারা ফেলতে, না পারছে তারা গিলতে। এখনো তারা চাচ্ছে আপদ বিদায় হোক। সেদিন নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে যা ঘটলো, সেটি একথার সত্যতা বহন করে। পুলিশ বিএনপির সমাবেশে লাঠিচার্জ করে ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। অন্তত ৫০ জন বিএনপি কর্মী ও সমর্থক আহত হয়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে পুলিশের নাকের ডগার ওপর দিয়ে পুলিশের দুইটি গাড়ি জালিয়ে দেয়া হয়। অথচ পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। টেলিভিশনে দেখা গেল, দীর্ঘ সময় ধরে ওই আগুন জলছে । অথচ সে আগুন নেভানোর কোনো প্রচেষ্টা নেই। উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার। তারা জনগণকে দেখাতে চেয়েছিল যে বিএনপির ছেলেপেলেরা আগুন লাগিয়েছে। অর্থাৎ তারা ২০১৫ সালের মত আবার অগ্নি সন্ত্রাস করছে। নির্বাচনের বর্তমান পর্যায়ে পুলিশের এই আচরণ নিন্দনীয়। কারণ, যেদিন থেকে তফসিল ঘোষিত হয়েছে সেদিন থেকে পুলিশ আর শেখ হাসিনার পুলিশ নয়। সেদিন থেকে পুলিশ সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের অধীনে। আলোচ্য ক্ষেত্রে পুলিশ সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী পন্থী পুলিশ বাহিনীর মত আচরণ করেছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জনাব আসাদুজ্জামান এ ব্যাপারে যা বলেছেন সেটি সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট। তিনি বলেছেন, সমগ্র ঘটনাটি বিএনপি ঘটিয়েছে। সেই পুরাতন ট্র্যাডিশন অনুযায়ী সরকার পক্ষ ও বিরোধী পক্ষের সংঘর্ষ দেখানো হয়েছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর কাউকে সরকার পক্ষ এবং কাউকে বিরোধী পক্ষ বলারও সুযোগ নেই। আরও অবাক ব্যাপার হলো এই যে দুটি গাড়ি পোড়ানো এবং কয়েকটি গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগে আসামী করা হয়েছে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদশ্য প্রাক্তন মন্ত্রি মির্জা আব্বাস, তার পতœী আফরোজা আব্বাস, হানিফ পরিবহনের মালিক জনাব হানিফসহ ৩৭৫ জনকে। প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী বেবী নাজনীনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ৪ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এডভোকেট নিতাই চন্দ্র রায়ের কন্যা এবং গয়েশ^র চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ এডভোকেট নিপুন রায় চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু নিপুন রায় নয়, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক আরিফা সুলতানা রুমা, খিলক্ষেত থানা বিএনপির সভাপতি ইউসুফ মৃধা, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলা বিএনপি নেতা আমির হোসেন এবং বিএনপি কর্মী মো: মোহসিন ও মামুনুর রশিদ খোকনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, নিপুন রায় ও আরিফা সুলতানা রুমাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

এটি একটি নজীরবিহীন ব্যাপার যে দু’জন শিক্ষিতা তরুণীকে শুধুমাত্র গ্রেফতার নয়, রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। তাও একেবারে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই ১০ বছরের শাসন ছাড়া বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো শিক্ষিত তরুণীকে ৫ দিনের পুলিশি রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা শোনা যায়নি।
দুই.
এই সরকারের সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের বড়ো গলায় বলেছেন যে, যেদিন তফসিল ঘোষিত হয়েছে সেদিন থেকে সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে গেছে। যদিও সংবিধানে লেখা নেই তবুও বর্তমান সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হিসাবে কাজ করছে। তারা শুধুমাত্র রুটিন কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হচ্ছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল আগের মতই হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাসিয়ে বেড়াচ্ছেন। পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া নয়াপল্টনের ঘটনার পর যে বিবৃতি দিয়েছেন সেটি কোনো পেশাদার পুলিশ অফিসারের বক্তব্য হয়নি। মনে হয়েছে, কোনো একজন দলীয় পুলিশ অফিসার বক্তব্য দিচ্ছেন। স্বাভাবিক অবস্থাতেই কোনো সরকারি অফিসার এমন কোনো বক্তব্য দিতে পারেন না, যেখানে মনে হতে পারে যে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব আছে। আর এখন তো চলছে নির্বাচন কমিশনের প্রশাসন। অন্তত আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথা অনুযায়ী। আছাদুজ্জামান মিয়ার এমন দলীয় বক্তব্য এবং নিপুন ও রুমার রিমান্ডের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কি করছে? নির্বাচন কমিশনকে বলতে হবে, এসব ব্যাপারে তাদের ভূমিকা কি? যদি তারা সেটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে এই নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহ। এটি একটি আওয়ামী নির্বাচন কমিশন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৪৭২ জন বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। বিএনপির গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের একটি তালিকা গতকাল নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বরাবর জমা দিয়েছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্রীয় মামলা তথ্য সংগ্রহকারী কর্মকর্তা মোঃ সালাহউদ্দিন খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের তালিকা ও সিইসি বরাবর একটি চিঠি জমা দেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ৮ নবেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এবং আশপাশের এলাকাসহ সারা দেশ থেকে দলের ৪৭২ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই মর্মে ৫টি এজাহারও পাওয়া গেছে। গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের পদ তালিকা জমা দেয়া হলো। পরবর্তীতে আরও পাওয়া গেলে সেগুলোও জমা দেওয়া হবে।

বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেয়া ‘বানোয়াট মামলা’ প্রত্যাহারসহ নিঃশর্ত মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপও কামনা করেন মির্জা ফখরুল। এর আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৪ নভেম্বর বুধবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচন কমিশন বলেছিল, তফসিলের পর যদি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়, তাহলে নাম-পদবিসহ সেটার তালিকা দেওয়ার জন্য। তালিকা দেখে হয়রানিমূলক মামলা বা গ্রেফতার করা হলে ব্যবস্থা নেবে ইসি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইসিতে তফসিলের পর গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের নাম-পদবীসহ তালিকা জমা দিল বিএনপি। তফসিল ঘোষণার পর ৪৭২ জন অর্থাৎ প্রায় ৫০০ ব্যক্তির গ্রেফতার সোজা কথা নয়। ১০ দিনে ৫০০ ব্যক্তির গ্রেফতার, অর্থাৎ প্রতিদিন ৫০ ব্যক্তির গ্রেফতার সহজ কথা নয়। প্রতিদিন ৫০ ব্যক্তি গ্রেফতার হচ্ছে, সে গ্রেফতার ১০ দিন ধরে চলছে, তার পরও ইলেকশন কমিশন নির্বিকার। এটি কি কল্পনা করা যায়? এটি কোন টাইপের ইলেকশন কমিশন? তাদের কি বিন্দুমাত্র স্বাতন্ত্র্যবোধ নাই? এমন ঠুটো জগোন্নাথ কমিশন বা সাক্ষী গোপাল কমিশন আমরা জীবনে দেখিনি।

নয়াপল্টনের ঘটনাকে কোনোক্রমে খাটো করে দেখা যায় না। ঘটনা একটি। কিন্তু মামলা তিনটি। এই তিনটি মামলায় ৪৮৮ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশকে আক্রমণ, তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি, তাদের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি মামলায় ১৯২ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অপর দুটি মামলায় যথাক্রমে ১৫৯ ও ১৩৭ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই তিনটি মামলা সম্পূর্ণ সাজানো। কারণ ৫০০ ব্যক্তি যদি সেদিন পুলিশকে আক্রমণ করতো তাহলে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা হতো। তাহলে সেদিন সেখানে দক্ষ যজ্ঞকা- বেধে যেত। অথচ দেখা গেল, দুটি পুলিশের গাড়ি জ¦লছে এবং সেই দৃশ্যটিই টেলিভিশনে বারবার দেখানো হচ্ছে।
তিন.
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। বিশেষ করে তাঁদের বর্তমান ও অতীত রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি ও আধা-সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া হয়। সেই তালিকা থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করেন। কিন্তু পুলিশ এভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। পুলিশ যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করছে তার মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সরকারের অন্য কোনো মতলব রয়েছে। সরকার চায় যে প্রিজাইডিং অফিসার সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার এক মতাবলম্বী হোক। অর্থাৎ আওয়ামী মতাবলম্বী হোক। এটি হলে নির্বাচনে যে সে কারচুপি নয়, রীতিমতো পুকুর চুরি করা যাবে। সেই কতদিন থেকে বিরোধী দল লেভেল প্লেইং ফিল্ডের কথা বলছে। তফসিল ঘোষণার পর ১০ দিন চলছে। আজও যেভাবে ইলেকশন কমিশন তাদের কর্মকা- চালাচ্ছে তার ফলে ইতোমধ্যেই লেভেল প্লেইং ফিল্ডের ১২টা বেজে গেছে।

http://www.dailysangram.com/post/353806