১৫ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:০৯

ব্যাংকগুলোতে অর্থ সংকট ॥ ঋণ পাচ্ছে না কৃষকরা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: ব্যাংকগুলোতে অর্থ সংকটের কারণে ঋণ পাচ্ছে না কৃষকরা। ভোটের আগে কৃষিঋণ বিতরণেও ব্যাংকগুলো সতর্কতা অবলম্বন করছে। এর ফলে কমে গেছে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা কৃষি ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কৃষকরা জোটবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় আবেদন করলেও ব্যাংক তাদের ঋণ দিচ্ছে না। ফসল উৎপাদনের জন্য সারাদেশের কৃষক চাহিদামতো ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। তবে ঘুষ দিলে ঋণ মিলে বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। কৃষকদের অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে।

জানা গেছে, দেশের ৩০টিরও বেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এখন নগদ টাকার সংকট চলছে। বাকি ব্যাংকগুলোও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমে সেপ্টেম্বরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমেছে ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের পর এতো কম প্রবৃদ্ধি আর দেখা যায়নি। আগের মাস আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, অর্থ সংকট ছাড়াও ঋণ আদায় কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো এখন ঋণ বিতরণে বেশি আগ্রহী হচ্ছে না। এমনকি কৃষিঋণও দেখে শুনে দিতে হচ্ছে।
কৃষক যে আগের মতো ঋণ পাচ্ছেন না তার প্রমাণ মেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে অর্থ সংকটের কারণে কৃষিখাতের ঋণ বিতরণ প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ কমে গেছে। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ খাতে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৪২ কোটি টাকা কম। আগের অর্থবছরের (২০১৭-১৮) একই সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছিল চার হাজার ২৩৫ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলার কৃষকরা জানান, গত ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে আমরা দলগতভাবে কৃষি ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোতে ঘুরেছি, কিন্তু ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে না। আবার দু’একজনকে দিলেও তার পরিমাণ মাত্র ২০ হাজার টাকা। দালালকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে ব্যাংক এক থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ দেয়, আর ঘুষ না দিলে প্রকৃত কৃষক ঋণ পায় না।
তবে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কৃষকদের অভিযোগ ঠিক নয়, যে সব কৃষকের আবেদনে কোনো ত্রুটি নেই, তাদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আর যারা এখনও ঋণ পাননি তাদের পর্যায়ক্রমে ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৪১ লাখ পরিবার কৃষি ও পল্লী ঋণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেও তাদের ঋণ দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ পরিবার কোনো ধরনের তদবির করতে না পারায় তাদের কৃষিঋণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আরও ৭ শতাংশ পরিবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের খুশি করতে না পারায় ঋণ পায়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষিঋণে বেসরকারি ব্যাংকের তুলনামূলক নজর কম। সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রায় ৮ শতাংশ ঋণ কৃষিতে, সেখানে বেসরকারি ব্যাংকের ২ শতাংশের কম। যদিও কৃষিতে তুলনামূলক খেলাপি ঋণ অনেক কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের ২ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণ পল্লী অঞ্চলে বিতরণ করা বাধ্যতামূলক হলেও তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশী-বিদেশী খাতের ৮টি ব্যাংক কৃষি খাতে কোনও ঋণ বিতরণ করেনি। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশী ব্যাংক আল ফালাহ, সিটি ব্যাংক এনএ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং ওরি ব্যাংক। এ ছাড়া মধুমতি এবং সীমান্ত ব্যাংক কোনো ঋণ বিতরণ করেনি।
পল্লী অঞ্চলে অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে কৃষিঋণ বিতরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দেশনাও জারি করে। তখন থেকেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে অনার্জিত লক্ষ্যমাত্রার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখার নিয়ম রয়েছে। এদিকে তারল্য সংকটের অজুহাতে কৃষিঋণ বিতরণের এ বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানোর চাপে রয়েছে ব্যাংকগুলো। এ কারণে কৃষিঋণেও প্রভাব পড়ছে। তবে কৃষিখাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতা অব্যাহত আছে। কৃষিঋণ সাধারণত মৌসুমভিত্তিক বিতরণ হয়। তাই বছর শেষ হতে হতে এটা সমন্বয় হয়ে যাবে।

২০১৮-১৯ অর্থবছর কৃষিখাতে মোট ২১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রার ৫২ শতাংশ বিতরণ করবে বেসরকারি খাতের ব্যাংক। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিতরণ করবে ৩০ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংক বিতরণ করবে ১৫ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংক বিতরণ করবে তিন শতাংশ ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো কৃষিতে মাত্র এক হাজার ১৫১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। আগের বছরের একই মাসে বিতরণ হয়েছিল এক হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে জুলাইয়ে বিতরণ কম হয়েছে ৪২৩ কোটি টাকা যা প্রায় ২৭ শতাংশ কম। প্রথম মাসে বিদেশী মালিকানার সাতটি এবং বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংক এক টাকাও ঋণ বিতরণ করেনি।

 

http://www.dailysangram.com/post/353472