১৫ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৩:৫৪

কোন পথে একাদশ সংসদ নির্বাচন

আমরা জানি, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। তবে যেনতেন নির্বাচন নয়, সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের কাম্য। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা অর্থবহ হয় না, জনমতের প্রতিফলনও তাতে ঘটে না। সামনে আমাদের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এই নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে তা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কিছু করণীয় আছে। যেমন সংসদ ভেঙ্গে দেয়া এবং তার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এমনটি করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে সংসদ বহাল রেখে ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচনের গণআকাক্সক্ষা পূরণ হবে না। সংলাপের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি ইতিবাচক পথেই এগোচ্ছিল। কিন্তু এই অবস্থায় হঠাৎ তফসিল ঘোষণা সুষ্ঠু ও অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচনের অন্তরায় হয়ে উঠেছে বলে অনেকে মনে করেন। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের সন্দেহের বার্তা দেয়। সন্দেহ দূর করার ক্ষেত্রে সরকার যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতে পারে।

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের বিশিষ্টজনরা এখন কথা বলছেন, পরামর্শও দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান উপাদান দু’টি- এক. আগ্রহী সব রাজনৈতিক দলের নির্বিঘ্নে অংশগ্রহণ, দুই. নির্বাচনে ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটদান। আর এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। সরকারকে এই দায়িত্ব নিতে হবে দুটি কারণে- এক. সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে, দুই. সরকারি দলও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তাই নির্বাচনে যাতে যথার্থ প্রতিদ্বন্দ্বী থকে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। এটা নিশ্চিত করা না হলে যে নির্বাচন হবে তাতে যারাই বিজয়ী হবেন সে বিজয় কোন গৌরব বয়ে আনবে না। তাছাড়া তেমন একটি নির্বাচনে বিজয়ীদের প্রতি জনগণের আস্থায়ও ঘাটতি পড়বে।
সরকার এখন দুইভাবে অগ্রসর হতে পারে- এক. বিশিষ্টজনদের পরামর্শ মেনে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি নিশ্চিত করা, দুই. যৌক্তিক পরামর্শকে অবজ্ঞা করে নিজেদের বিজয়কে নিশ্চিত করা। সরকার কোন পথে অগ্রসর হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

গণতন্ত্রের কথা সরকার বলে, বিরোধীদল বলে, বলে নির্বাচন কমিশনও। কিন্তু এত বলার পরেও এখন প্রশ্ন জেগেছে, গণতন্ত্র কোথায় আছে, কতটা আছে? এমন প্রশ্নের কারণ আছে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গত ৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান থামেনি। দেশজুড়ে গণগ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। ফলে পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, তফসিল ঘোষণা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের হাতেই রয়ে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে গ্রেফতারের জন্য।
গত বুধবার ৭ নভেম্বর দুপুরে নাশকতার অভিযোগে দামুড়হুদা উপজেলা কার্যালয় থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও চুয়াডাঙ্গা জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা আজিজুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই অভিযোগে বিএনপি নেতা বেগমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলি হোসেন, জামায়াত কর্মী কুড়ুলগাছি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সরফরাজ উদ্দীন এবং একই উপজেলার কুনিয়া চাঁদপুর গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। এর বাইরে আরো ৩৪ জনকে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য যে, ৮ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয় গ্রেফতারকৃত কয়েকশ’ মানুষকে। গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্য তাদের অনেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাচ্ছিলেন। পথে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে জানা যায়। আগের দিন গ্রেফতার করা হয় শাহবাগ থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক চঞ্চলসহ বেশ কয়েকজনকে। ৮ নভেম্বর সকাল থেকে আদালত চত্বরে দেখা যায়, শত শত মানুষকে। তারা অপেক্ষা করছেন আপনজদের জন্য।

সম্প্রতি যেসব গায়েবি মামলা হয়েছে, ওইসব মামলার সূত্র ধরে পুলিশ নতুন করে গ্রেফতার অভিযানে নেমেছে বলে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশে গায়েবি মামলার সংখ্যা চার হাজার ৩৭১টি। এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে ২৫ লাখ নেতাকর্মীকে। বিএনপির পক্ষ থেকে এসব গায়েবি মামলার তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এদিকে বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদার পরও হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তারা কেউ বাড়িঘরে থাকতে পারছেন না। বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নেয়ার আশ্বাস দিলেও মামলার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এমন চিত্রকে কি নির্বাচন কিংবা গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী বলে বিবেচনা করা যাবে?
‘সংলাপের পর ১০০ মামলা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে প্রথম আলো পত্রিকায়। ১২ নবেম্বরে মুদ্রিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোলচত্বরের কাছে ৬ নবেম্বর দুপুরে কিছু লোককে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাতে ও গাড়ি ভাঙচুর করতে ‘দেখেছে’ পুলিশ। কিন্তু কদমতলার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিস্ফোরণ হলে অন্তত শব্দ শোনা যেত। ভাঙচুর হলে এলাকায় শোরগোল হতো। এ ছাড়া সেদিন সকাল থেকেই কদমতলী এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ভাঙচুরের ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঘটনাস্থল থেকে ১৩ জনকে গ্রেফতার করার কথা মামলায় উল্লেখ করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, সেদিন পুলিশ গাড়ি থেকে নামিয়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে।

এ ধরনের মামলাকে কী নামে অভিহিত করা যায়? এমন কর্মকাণ্ডকে নিশ্চয়ই সুশাসনের উদাহরণ হিসেবে কেউ উল্লেখ করবেন না। ওই ধরনের মামলার কথা ১ নবেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম দফার সংলাপে তুলে ধরেছিলেন বিএনপি নেতারা। তখন প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ১ থেকে ১০ নবেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ২০ জেলায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০০টি। এর মধ্যে ৯৭টি মামলারই বাদী পুলিশ। বিএনপি নেতাদের দাবি, এই মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও গায়েবি। আর ৬ নবেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের দিন ঢাকার ছয়টি থানায় ছয়টি মামলা হয়। এ সব মামলায় গাড়ি ভাঙচুর, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি, পুলিশের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণসহ নাশকতার কথা উল্লেখ রয়েছে। ছয়টি মামলায় ঘটনাস্থল থেকে ১৩৮ জনকে গ্রেফতার করার কথা বলেছে পুলিশ। কিন্তু যে এলাকায় এবং যে সময়ে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দাদের সথে কথা বলে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। উল্টো এসব ঘটনার বিবরণ শুনে স্থানীয় লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
এমন বিস্ময় সৃষ্টি করা তো পুলিশের কাজ হতে পারে না। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন পুলিশের কাজ। ওই ধরনের মামলা কি পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে তো পুলিশ ও প্রশাসনের কাজ করার কথা নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে মামলা দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু অনুচিত কাজ তো অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে কারও কি কিছু করণীয় নেই। এমন রোডম্যাপেই কি সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/353453