১২ নভেম্বর ২০১৮, সোমবার, ২:৩৩

যানজটে স্থবির ঢাকা

মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শোডাউন

নজিরবিহীন আরেকটি যানজটের কবলে পড়ে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাল নগরবাসী। আওয়ামী লীগের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে গতকাল দুপরের পর রাজধানীর ধানমন্ডিতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে মিরপুর-গাবতলী হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক একেবারে থমকে যায়। এর প্রভাবে পুরো ঢাকা এক সময় স্থবির হয়ে পড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকায় দুর্বিসহ হয়ে পড়ে নগরজীবন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণা করলে শুক্রবার থেকেই মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা শোডাউন নিয়ে ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে এলে নজীরবিহীন এ যানজটের সৃষ্টি হয়।

গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল ৮টা থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ের দিকে আসতে শুরু করে নেতা-কর্মীরা। প্রতিটি মিছিলে মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান ও বাসে চড়ে সমর্থকরা নেতার পক্ষে সমর্থ দিচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনো ধরনের সিগন্যাল বা নিয়মের তোয়াক্কা না করে এসব শোডাউন করে সরকার দলীয় সমর্থকরা। যানবাহন চলাচল বন্ধ করে মিছিল করে তারা। মিছিলে থাকা মোটরসাইকেলের বহরের কেউ ট্রাফিক আইন মানেনি। অধিকাংশ চালক ও যাত্রীর মাথায় হেলমেট নেই। প্রতিটি মোটরসাইকেলে দু’জনের বেশি বসার নিয়ম না থাকলেও অধিকাংশ মোটরসাইকেলে তিনজন দেখা গেছে। ট্রাফিক সদস্যরা বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্বপালন করলেও তারা ছিলেন নির্বিকার। প্রার্থীদের সাথে আসা অধিকাংশ সমর্থকরা ট্রাফিক নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে রাস্তায় মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি ধাপিয়ে বেড়ান। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দেখা গেছে মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, সাইন্সল্যাব, তেজগাঁও ও বিজয় সরণী এলাকায়। এসব এলাকায় যান চলাচল এক কথায় স্থবির হয়ে পড়ে। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। যার প্রভাব পরে রাজধানীর অন্যান্য সড়কে।

ট্রাফিক সূত্রে জানা গেছে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর ধানমন্ডি জুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যা ধানমন্ডি থেকে গাবতলী-আমিনবাজার ছাড়িয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুর ছাড়িয়ে যায়। এতে মহাসড়কে হাজার হাজার যানবাহন আটকে পড়ে। সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। অনেকে বাধ্য হয়ে পায়ে হেটে গন্তব্যে রওয়ানা হয়। অন্যদিকে, ধানমন্ডির যানজটের প্রভাবে মিরপুর, ফার্মগেট, বাংলামোটর, নিউমার্কেট, শাহবাগ, মগবাজারসহ আশপাশের এলাকাও স্থবির হয়ে পড়ে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুরে এক ভুক্তভোগী যাত্রী বলেন, দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একই স্থানে আটকে আছি। গাড়ি একদম নড়ছে না। কখন যে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো সেটি জানি না।

ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম সূত্র বলছে, যানজটের কারণেই মূলত সড়কে মানুষের ভীড়। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাথে আগ্রহী সমর্থকদের বিশাল শোডাউন নিয়ে আসায় এ যানজটের সৃষ্টি হয়। দায়িত্বপালনকারী এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দুপুরে ক্রিকেট তারকা মাশরাফি বিন মর্ত্তুজা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে ধানমন্ডি আসলে তার সাথে হাজার হাজার ভক্ত-সমর্থক ধানমন্ডিতে আসেন। এ ভক্তদের কারণেই যানজট ক্রমে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। একইভাবে গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে প্রায় দু’শ গাড়িবহর নিয়ে ধানমন্ডি এসে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ঢাকা-৭ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। তার গাড়ির বহর দেখে অনেকের চোখ চড়কগাছ হওয়ার অবস্থা। একদিকে গত কয়েকদিনের যানজটে নাকাল নগরবাসী, এর মধ্যে হাজী সেলিমের এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।

ভুক্তভোগী নগরবাসী বলেন, তফসিল ঘোষণার পর এমন শোডাউন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) লঙ্ঘন। তারা বলেন, শোডাউনের খপ্পরে পড়ে ধানমন্ডি এলাকার মতো ঢাকার অন্যান্য এলাকায় প্রচন্ড যানজট তৈরি হয়। এতে নগরীর বেশিরভাগ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। ধানমন্ডি এলাকায় বেশি স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থাকায় এখনকার মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে।

রাজধানীর অনেক বাসীন্দা মনে করেন, নির্বাচনের আগে এমন শোডাউনে জনভোগান্তি অনেক বেড়ে গেছে। যার কারণে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ব্যাপারে ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। অনেক ভুক্তভোগীকে অসন্তোষ প্রকাশ করে কটু কথা বলতে শোনা গেছে। শোডাউনের কারণে নগরবাসীর হয়রানি বাড়ায় ক্ষোদ আওয়ামী লীগের অনেকেও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি।

ধানমন্ডির বেসরকারি চাকুরে রফিক মাহমুদ বলেন, গত দুইদিনের যানজটে এখানকার বাসীন্দার বন্দী জীবনযাপন করছে। তিনি প্রাইভেটকার নিয়ে দুই ঘন্টার বেশি সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন বলে জানান।

মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী আলী আজম বলেন, সব কিছুতে নিয়ম শৃঙ্খলা থাকা উচিত। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, জনগনের জন্য নির্বাচন, অথচ মনোনয়নপত্র সংগ্রহকে কেন্দ্র করে যানজটে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাফিক বিভাগের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এত বেশি নেতাকর্মী নিয়ন্ত্রণ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাদেরকে বোঝানো হলেও তারা কোন কথা শুনতে চায় না। কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারা চাইলেই বিষয়টি সুরাহা করতে পারেন। এত বড় শোডাউন না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/165303