১১ নভেম্বর ২০১৮, রবিবার, ২:০৬

সার্বক্ষণিক কারিগরি টিম না রাখায় প্রশ্ন

এলএনজিতে দায়সারা এক্সিলারেট

এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) পাইপলাইনে সমুদ্রের তলদেশে গোড়াতেই ত্রু টির কারণে বন্ধ রয়েছে গ্যাস সরবরাহ। তীব্র গ্যাস সঙ্কটে ধুঁকছে বন্দর-শিল্প কল-কারখানা ও বিনিয়োগের মহানগরী চট্টগ্রাম অঞ্চল, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ।

স্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী ও রফতানিমুখী চট্টগ্রামের দুই শতাধিক ভারী ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস ও কম্পোজিট টেক্সটাইল, সার কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসন, ভোজ্যতেল, স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিলস, বিভিন্নমুখী ব্যবসা-বাণিজ্যিক খাতে লালবাতি জ্বলার উপক্রম হয়েছে। দৈনিক কোটি কোটি টাকা লোকসান গুণছে এসব শিল্প-বাণিজ্য খাত। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যাসের অভাবে বাসাবাড়িতে লাখো মানুষকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। গ্যাস সঙ্কটকে পুঁজি করে বিভিন্ন কোম্পানির এলপি গ্যাসের খুচরা বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো বাড়তি দাম উসুল করছে। ক্রেতারা হয়ে পড়েছেন অসহায়।

কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ী সংলগ্ন সমুদ্র তলদেশে (সাব-মেরিন) পাইপলাইনের রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট সংলগ্ন গোড়ায় হাইড্রোলিক ভাল্ব অকার্যকর হয়ে পড়ার পর এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। অথচ গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত ভাল্ব মেরামত করে ত্রুটি সারানোর কাজে বাস্তব কোনো অগ্রগতি হয়নি। আজ-কালের মধ্যে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ডুবুরিদের সহায়তায় পুরোদমে মেরামত শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। যদি হাইড্রোলিক ভাল্ব মেরামত সম্ভব বা সম্পন্ন করা যায় এবং যদি অন্য কোনো কারিগরি ও যান্ত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকে তাহলে এক অথবা দুই সপ্তাহের মধ্যে এলএনজির উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ পুনরায় সচল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একথা জানায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্র। অর্থাৎ এ মুহূর্ত অবধি সবকিছুই নির্ভর করছে ‘যদি’র ওপর।

এদিকে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, এলএনজি সমস্যার পেছনে দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট বিদেশি কোম্পানি ‘এক্সিলারেট এনার্জি’র আগাগোড়ো অবহেলা, নির্লিপ্ততা ও দায়সারা ভূমিকাই মূল কারণ। কেননা মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনাল, রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট ও সমুদ্র তলদেশের পাইপলাইনের প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নির্মাতা কোম্পানিটির। মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনালযুক্ত জাহাজ (ট্যাংকার), এর সাথে যুক্ত রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট (তরলীকৃত গ্যাসকে প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তরিতকরণ) এবং সমুদ্র তলদেশের (সাব-মেরিন) পাইপলাইনের সম্ভাব্য যে কোনো সময়েই যে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ, ত্রু টি-বিচ্যুতি দেখা দিতেই পারে। এরজন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জিরই দায়-দায়িত্ব সেখানে সার্বক্ষণিক জরুরি বিবেচনায় ডুবুরি দল ও দক্ষ কারিগরি টিম প্রস্তুত রাখা। কিন্তু তার ব্যত্যয় ঘটার কারণেই এলএনজি টার্মিনাল ও পাইপলাইনের সাথে সংযুক্ত হাইড্রোলিক ভাল্বটি মেরামতের বিষয়টি অহেতুক অনিশ্চয়তায় ঝুলে গেছে। গত ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় হাইড্রোলিক ভাল্ব অকেজো হওয়ার পর এখনও তা মেরামত করা হলো না। সমুদ্র তলদেশে প্রায় ৪০ মিটার নিচে এই কারিগরি ত্রু টি দেখা দিয়েছে। এরজন্য সিঙ্গাপুর থেকে এক্সিলারেটের কারিগর এনে সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়ে মেরামতের দীর্ঘসূত্রতার চক্করে গ্যাস সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ।

যেহেতু বাংলাদেশে এলএনজি আমদানি, প্রসেসিং ও সরবরাহ ব্যবস্থা একটি নতুন অভিজ্ঞতা, এরজন্য যে কোনো প্রকারের সম্ভাব্য কারিগরি সমস্যার জন্য এক্সিলারেট এনার্জির পর্যাপ্ত পূর্ব-প্রস্তুতি থাকা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু তা না থাকায় এ নিয়ে সঙ্গত কারণেই উঠেছে প্রশ্ন। তাছাড়া গত ২৪ এপ্রিল এলএনজিবাহী প্রথম সর্ববৃহৎ জাহাজ ‘এক্সিলেন্স’-এর মাতারবাড়ী সংলগ্ন সমুদ্রে এসে পৌঁছার পর এক্সিলারেট এনার্জির কারিগরি ব্যবস্থাপনায় খালাস, রি-গ্যাসিফিকেশন এবং সরবরাহ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রস্তুতি দেয়া হয় পুরোদমে। কিন্তু তখনও চালু হওয়ার আগেই সমুদ্র তলদেশের পাইপলাইনে ত্রু টি-বিচ্যুতি এবং ফুটো ধরা পড়ে। এরপর ডুবুরি দল ও কারিগরের সাহায্যে মেরামত ও নানামুখী জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা শেষে মেরামতে লেগে যায় প্রায় ৪ মাস। অবশেষে গত ১৮ আগস্ট দেশে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এলএনজি সরবরাহ শুরু করা হয়। এরফলে গ্রাহকগণ কিছুটা আশার নিশানা দেখতে পেলেন। অথচ আড়াই মাস যেতে না যেতেই এবার সমুদ্র তলদেশে পাইপলাইনের হাইড্রোলিক ভাল্ব অকেজো হয়ে পড়ার কারণে ৩ নভেম্বর থেকে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। সবার জিজ্ঞাসা কবে শেষ হবে মেরামত, কবে মিলবে এলএনজি উৎসের গ্যাস?

এদিকে এলএনজি উৎসের গ্যাস সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় বৃহত্তর চট্টগ্রামে শিল্প-কারখানায় এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা হঠাৎ করে সঙ্কটে পড়েছে। এলএনজির উৎসে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. (কেজিডিসিএল) দৈনিক ৩২০ মিলিয়ন থেকে ৩৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়ে আসছিল। এখন চট্টগ্রামে সঙ্কট আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সামাল দেয়া হচ্ছে জাতীয় গ্রিড থেকে ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগানে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বৃহত্তর চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

এলএনজির উৎসের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আবার বিদ্যুৎচালিত কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য পড়েছে অচলাবস্থার মুখে। বেড়েছে লোডশেডিং। গ্রামে-গঞ্জে তা আরও ব্যাপক। গ্যাস না পেয়ে রফতানিমুখী শিল্প মালিকরা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু রাখতে পারছেন না। এলএনজির সমুদ্র তলদেশের পাইপলাইনের ভাল্ব বিকল হয়ে পড়ায় গ্যাসচালিত রাউজানের ৪২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিকলবাহা ৬০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।

এলএনজি সরবরাহ শুরু হতে না হতেই ফের অচল হয়ে পড়ার কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এবং বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সঙ্কটের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এলএনজির উৎস থেকে ৫০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস পূরণ না হতেই এবং ৩০০ থেকে ৩২০ কোটি ঘনফুটে সীমিত থাকাবস্থাতেই তা বিগড়ে যাওয়ায় গ্রাহকগণ ভোগান্তির পাশাপাশি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। ইতোমধ্যে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে অবিলম্বে সঙ্কট নিরসন ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রামের মানবাধিকার-সামাজিক সংগঠনের তরফ থেকে।

https://www.dailyinqilab.com/article/165050