১০ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৪:০০

ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না উদ্যোক্তারা ; খেলাপি ঋণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে

বেহাল অবস্থায় রফতানিমুখী টেক্সটাইল ও বস্ত্রখাত

আশরাফুল ইসলাম: টেক্সটাইল ও তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। অন্য খাতগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম হারে ঋণ পরিশোধ করছেন। খাতভিত্তিক খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একক খাত হিসেবে এ দু’টি খাতে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি। বলা চলে মোট খেলাপির এক- চতুর্থাংশ খেলাপি ঋণ এ দু’টি খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছরে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ছিল তৈরী পোশাক খাতে সাড়ে ১৪ শতাংশ। আর টেক্সটাইল খাতে ১০ দশমিক ১ শতাংশ।
দেশের প্রধান দু’টি খাতের এ বেহাল অবস্থার কারণ সম্পর্কে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তারা চতুর্মুখী চাপে রয়েছেন। আগের মতো আয় হচ্ছে না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে ঘাটে ঘাটে ব্যয় বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যবসায় লোকসানের মুখে পড়ছেন তারা। আর এ লোকসানের ঘানি টানতে টানতে এক সময় উদ্যোক্তা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। পরে ব্যবসা বন্ধ করে দেউলিয়া হয়ে পড়ছেন। তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি উন্নতি করতে দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্বের প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো সেবা দিতে হবে। কমাতে হবে আরোপিত, অনারোপিত নানা ব্যয়। অন্যথায় দেশের রফতানি বাণিজ্য বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে। যার খেসারত পুরো অর্থনীতিকেই বহন করতে হবে। 
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণের খাতভিত্তিক প্রতিবেদন দিয়েছে গত বছরের তথ্যের ভিত্তিতে। গত বছর শেষে দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকাই তৈরী পোশাক খাত ও টেক্সটাইল খাতের। এর বেশির ভাগ মন্দ ঋণে অর্থাৎ আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। আর বাণিজ্যিক ঋণ রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যেও তৈরী পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের একটি অংশ রয়েছে। সব মিলে রফতানিমুখী প্রধান এ দু’টি খাতের এখন বেহাল অবস্থা। 
তৈরী পোশাক খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ হওয়ার পেছেনে কারণ কী এমনই এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএ) প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম মুর্শেদী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের তৈরী পোশাক খাত। বিশ্বব্যাপী এ খাতের ব্যবসার ধরনই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে এলসির মাধ্যমে তৈরী পোশাক বিক্রি করা হতো। এখন ক্রেতা ও চুক্তিভিত্তিক পণ্য বিক্রি করা হয়। যেমন, আগে পণ্য জাহাজে তোলার ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে বিদেশী ক্রেতারা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতেন। এখন এটি পরিবর্তন হয়ে চুক্তিভিত্তিতে করা হয়। পণ্য জাহাজে পাঠানোর পর ক্ষেত্রবিশেষ ১২০ দিন পরও বিদেশী ক্রেতারা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেন, যদি ওই ক্রেতা তার দেশে ঠিকঠাকমতো পণ্য বিক্রি করতে পারেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ৯০ দিনের মাথায় বিক্রি করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেন ক্রেতারা। তবে, ক্রেতা তার দেশে পণ্য বিক্রি করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্যও পাওয়া যায় না। এভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে এক সময় ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে আমাদের পরিবর্তন হতে হবে। ব্যবসা ব্যয় কমানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা এ খাতের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। 
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ কী এমন এক প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেক্সটাইল খাতের একজন উদ্যোক্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এক কথায় বলতে গেলে তারা এখন চতুর্মুখী চাপে রয়েছেন। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম কমে গেছে। শুধু একটি খাতেই মূল্য কমে গেছে ৩০ শতাংশ। সেই সাথে কারখানা আধুনিকায়ন করতে বিদেশী ক্রেতাদের নানা শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। যেমন, এক একটি কারখানা ক্রেতাদের শর্ত মেনে আধুনিকায়ন করতে ৫ কোটি টাকার ওপরে ব্যয় হয়েছে। এভাবে এক হাজার কারখানার জন্য উদ্যোক্তাদের ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। এতে উদ্যোক্তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। কিন্তু আয় কমলেও ব্যবসা ব্যয় কমেনি। বরং ঘাটে ঘাটে ব্যয় বেড়ে গেছে। পৃথিবীর কোনো দেশে নেই ব্যাংকঋণের সুদ ও নানা সার্ভিস চার্জসহ ১০০ টাকা ঋণ নিলে ১৫ টাকা ব্যয় করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ১০০ টাকা ঋণ নিলে এখনো ১৫ টাকা ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি কাস্টমসের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিদেশী ক্রেতারা একটি পণ্যের অর্ডার দেয়ার ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তাদের পণ্য ডেলিভারি চায়। কিন্তু ওই পণ্যের কাঁচামাল ছাড় করতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যায়। তৈরী পোশাক খাত ও টেক্সটাইল খাতের কোনো কিছুর অনুমোদনের জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের লাগে ৩ থেকে ৭ দিন। যেখানে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর উদ্যোক্তাদের ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা। এর বাইরে উৎসে কর কাটা হয় এ খাতের রফতানিকারকদের কাছ থেকে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। সব মিলে পণ্য বিক্রি করে একজন রফতানিকারকের যে পরিমাণ আয় হচ্ছে, নানা কারণে ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। ফলে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করতে পারছেন না। এভাবে একজন ভালো উদ্যোক্তা ব্যবসায় নেমে ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে নিজের মূলধন খুইয়ে পথে বসে যাচ্ছেন। ব্যাংকের খাতায় ঋণখেলাপি হয়ে বাড়তি চাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। ওই উদ্যোক্তার মতে, দেশের রফতানিমুখী খাতকে গতিশীল করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আর তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দেশে শিল্পকারখানা রাখবে কি না। যদি বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে চায় তাহলে সরকারকে অবশ্যই প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে দেশে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় সামাজিক বিপর্যয় কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/363502/-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B0%E0%A6%AB%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%80-%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B8%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B2-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A4