১০ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৩:৫৮

তফসিল নিয়ে বিশ্লেষকেরা

তড়িঘড়ি তফসিলে সব কিছুই প্রশ্নবিদ্ধ

হামিদ সরকার: সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হলো ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। সে হিসাবে নির্বাচন কমিশনের হাতে বেশ সময় ছিল। যেখানে সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা সংলাপ চলছিল সেখানে এত তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সব কিছুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করল বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ইসি নিজে ভালো কোনো নির্বাচন চায় কি না তা নিয়েও এখন সন্দেহ রয়েছে। নতুন করে একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার পথ সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়।
উল্লেখ্য, আগামী ২৩ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) গত ৮ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তাতে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ১৯ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন ২২ নভেম্বর। আর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৯ নভেম্বর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, সময় হাতে থাকা সত্ত্বেও এত দ্রুত ও তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। যেখানে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে। আমি এটি বুঝতে পারি যে, ইসি তফসিলটা নভেম্বরের শেষে ঘোষণা করতে পারত। তাদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। এত তাড়াহুড়ার কোনো দরকার ছিল না। তিনি বলেন, নভেম্বরের শেষের দিকে তফসিল ঘোষণা করলে ২০ জানুয়ারির দিকে নির্বাচন হতো। তাহলে আরো কিছু সময় পাওয়া যেত। সরকারের সাথে বিরোধী দলের চলমান সংলাপ অব্যাহত থাকত। সংলাপ হলে হয়তো রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়ে আসত এবং সমঝোতার পথ বের হতো। এটিই আমরা আশা করে আসছিলাম। কিন্তু সেটি হলো না। এত আগে নির্বাচন করেও কোনো লাভ নেই। এক মাস অপেক্ষা করতে হবে এই দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার জন্য।
তার মতে, বিরোধীদলীয় জোট যদি অংশ না নেয়, তাহলে তো একরতফা হবে এ নির্বাচন। আর তারা অংশ নিলে তো হচ্ছে না। তিনি বলেন, যে তফসিল দেয়া হয়েছে তাতে বিরোধী দল প্রস্তুতি নিতেও পারবে না। এমনকি বিদেশী যে পর্যবেক্ষক আসতেন, তারাও আসতে পারবেন না। এ ধরনের তড়িঘড়ি তফসিল ঘোষণার পেছনে সরকারের একটি রাজনৈতিক লাভ রয়েছে। তিনি বলেন, ইসি নিজে ভালো কোনো নির্বাচন চায় কি না সেটি নিয়েও এখন সন্দেহ রয়েছে। নতুন করে একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার পথ সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। 
তফসিল নিয়ে অধ্যাপিকা দিলারা চৌধুরীর অভিমত হলো, পুরো পরিস্থিতিকেই ঘোলাটে করেছে সরকার ও ইসি। এক দিকে বলছে সংলাপ চলবে, অন্য দিকে রাজশাহীতে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ, অন্য দিকে মনোনয়নপত্র বিক্রি। পাশাপাশি চলছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়। আবার ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজশাহীকে পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ইসি বলছে, তফসিল পেছানো সম্ভব। পুরো দেশকে তারা একটি সংশয়ের মধ্যে রেখেছে। আমার মনে হচ্ছে দেশটাকে একটা সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। 
তিনি বলেন, এটি সরকারের রাজনৈতিক একটি কৌশল হতে পারে। তবে এ ধরনের রাজনৈতিক অবস্থা আমি জীবনে কোনো দিন দেখিনি, শুনিনি। তারা এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে ঐক্যফ্রন্টকে একটি সংশয়ের মধ্যে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেয়াও কঠিন হবে। সরকারি দল বিএনপি ও তার জোটকে নিশ্চিহ্নহ্ন করতেই এ পদক্ষেপ নিয়েছে।  
স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, সময় হাতে থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কেন ও কার স্বার্থে এত তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করল, সেটিই প্রশ্ন। এ তফসিল দিয়ে নিজেরা প্রশ্নবিদ্ধ হলো। তাদের উচিত ছিল নিজেদের স্বার্থে ও দেশের মানুষের স্বার্থে সংলাপকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করা। এতে সংলাপের মাধ্যমে একটি সমঝোতার পথ বের হয়ে আসত। নির্বাচনটা সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হতো।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, ইসি যেভাবে তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করে রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সংলাপকে কেন্দ্র করে সুবাতাসের যে ছোট্ট জানালাটি খোলা হয়েছিল, সেটি বন্ধ করে দিলো। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কমিশন ইতোমধ্যে যেভাবে নিজেকে বিতর্কিত করেছে, তার সাথে আরো একটি উপাদান যুক্ত হলো মাত্র।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদিও প্রায়ই সম্পূর্ণ অসম্ভব, তবু বলতে হয়, কমিশনকে বুঝতে হবে যে সবার জন্য সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করে নির্বাচনের ফলাফল যেন কেবল ভোটারের রায়ের ওপর নির্ভর করে। এরূপ পরিবেশ তৈরির কেন্দ্রীয় দায়িত্ব তাদেরই হাতে। আর এর প্রতিবন্ধক তা যেই হোক, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে নিবৃত্ত করার দায়িত্ব কমিশনেরই হাতে। তিনি বলেন, ব্যাপক বিতর্কিত বর্তমান কমিশন এই গুরুদায়িত্ব পালনে কতটুকু সৎসাহস ও দৃঢ়তা দেখাতে পারবে, এরূপ প্রশ্ন আর উৎকণ্ঠা থাকাটা স্বাভাবিক।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/363503/%E0%A6%A4%E0%A7%9C%E0%A6%BF%E0%A6%98%E0%A7%9C%E0%A6%BF-%E0%A6%A4%E0%A6%AB%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%AC-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%9B%E0%A7%81%E0%A6%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7