৭ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:৩৪

আপত্তির পরও কেনা হচ্ছে ৪২ হাজার ট্যাব!

ভোটের কাজে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ট্যাব দেয়া হবে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রযুক্তি ব্যবহারের অংশ হিসেবে ৪২ হাজার ট্যাব কেনার কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) আপত্তি সত্ত্বেও ভোট কেন্দ্রের পরিস্থিতি সংগ্রহ ও ফল দ্রুত পাঠানোর জন্য এ ট্যাব কেনা হচ্ছে। এসব ট্যাব প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ভোটের কাজে ব্যবহারের জন্য দেয়া হবে। কিন্তু ভোট কেন্দ্রে ট্যাব ব্যবহারের জন্য কোনো ধরনের বিধিমালা প্রণয়ন বা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ইসি সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, প্রতিটি ট্যাবের দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। ট্যাবের সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কয়েক ধরনের সফটওয়্যারও কেনা হচ্ছে। সবমিলিয়ে খরচ পড়ছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। যদিও এ টাকার সংস্থান নির্বাচন ব্যবস্থাপনা খাতে নেই। ট্যাব ও সফটওয়্যার কেনার প্রক্রিয়া নিয়েও নানা প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমরা শুধু ট্যাব নয়, কমপ্লিট সলিউশন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিইসি মহোদয় কারিগরি বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে এসব কেনার কথা বলেছেন, আমরা মতামত নিয়ে তা কিনছি।

ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯ মার্চ কমিশনের ২২তম সভায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পাইলটিং হিসেবে কিছু ট্যাব কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের জন্য ট্যাব কেনার প্রস্তুাব করে ইসির আইসিটি অনুবিভাগ। ওই প্রস্তাবে আপত্তি জানান সিইসি। আপত্তিতে সিইসি উল্লেখ করেন, নির্বাচনের মতো স্পর্শকাতর একটি কাজে বিধি প্রণয়ন না করে নতুন কোনো পদ্ধতির প্রয়োগ নির্বাচনকে আইনি জটিলতার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। দুটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ট্যাব ব্যবহার করে ভালো উপকার পাওয়া গেছে বলে মনে হয় না। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরীক্ষামূলক ট্যাব ব্যবহারে অত্যন্ত বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ট্যাব ব্যবহারের জন্য কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ট্যাব ব্যবহার নিয়ে কারিগরি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। সিইসি তার আপত্তিতে আরও উল্লেখ করে বলেন, ট্যাব ক্রয় ও ব্যবহার আর্থিক ও নির্বাচনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। জানা গেছে, সিইসির ওই আপত্তির পর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে পুনরায় ট্যাব ও বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার কেনার প্রস্তাব তোলা হলে সেটি অনুমোদন পায়। সূত্রমতে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পাইলটিং হিসেবে ট্যাব ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়নি। পাইলটিং ২৫টি কেন্দ্রের একটিতেও নির্দিষ্ট সময়ে ট্যাব ঢুকতে পারেনি। ৪টি ভোট কেন্দ্রের ট্যাব ছিনতাইয়ের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা উদ্ধার করেছে। জানা গেছে, ট্যাবের পাশাপাশি নির্বাচন ব্যবস্থাপনা এবং অফিস ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার কেনা হচ্ছে। ট্যাব ও সফটওয়্যার একই সঙ্গে কেনার প্রক্রিয়া শুরু করায় এগুলো পেতে সময় বেশি লাগছে।
ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ইসির ২২তম সভায় বৈঠকে ট্যাব কেনার বিষয়ে তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। সেগুলো হচ্ছে- কিছু কেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য দ্রুত বেশ কিছু ট্যাব কিনতে হবে, পাইলটিং হিসেবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এসব ট্যাব ব্যবহার এবং বিদ্যমান পদ্ধতি বহাল রাখতে হবে। এছাড়া নির্বাচনী ফল সরবরাহে ট্যাব ব্যবহার করতে হলে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার পরিবর্তন আনতে হবে। তারা জানান, বিধিমালা পরিবর্তন না করেই এ তিন সিদ্ধান্তের আলোকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪টি কেন্দ্রে ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ২৫টি কেন্দ্রে ট্যাব পাইলট আকারে ব্যবহার করা হয়। এতে সুফল পায়নি ইসি। তবুও কেনা হচ্ছে এসব। তারা বলেন, ট্যাবের সঙ্গে সফটওয়্যার কেনার জন্য টেন্ডারও আহ্বান করা হয়েছে। এ টেন্ডারের শর্তারোপ নিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আপত্তিও জমা পড়েছে।

আরও জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪০ হাজার ১৯৯টি। তবে এ সংখ্যা কিছুটা কমবেশি হতে পারে। প্রতিটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে একটি ট্যাব দেয়া হবে। এ ট্যাবের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ পরিস্থিতির তথ্য, নির্র্দিষ্ট সময় পর পর ভোট পড়ার হার ও ফল দ্রুত ইসি এবং রিটার্র্নিং কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছাবে। এছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ, কেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার সফটওয়্যার ওই ট্যাবে ইনস্টল করা থাকবে। ইসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনাকাটার হিড়িক পড়েছে। এরই অংশ হিসেবে এসব ট্যাব কেনা হচ্ছে। প্রথমে পাইলটিং করে সুফল পাওয়ার পর ট্যাব কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও সেই অবস্থা থেকে সরে এসেছে ইসি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের দিন ৪০ হাজারের বেশি ভোট কেন্দ্র থেকে পাঠানো ট্যাবের তথ্য একই সঙ্গে মনিটরিং করা ইসির পক্ষে অসম্ভব হবে। ইসি সাধারণত রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী ও নিজস্ব সোর্সে পাওয়া তথ্য বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তাই এ ট্যাব কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা সন্দিহান তিনি। আরেক কর্মকর্তা বলেন, বিগত কোনো নির্বাচনে ট্যাব ব্যবহার করা হয়নি। দুর্গম ও চরাঞ্চলের ভোট কেন্দ্রে ইন্টারনেট পাওয়া যাবে না। আর অদক্ষ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হলে ট্যাব ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা ও জ্ঞান আছে কি না তা দেখার বিষয়।

ট্যাব কেনার অর্থ সংস্থান নেই : জানা গেছে, ট্যাব ও সফটওয়্যার কেনার জন্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা চেয়ে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-২ অনুবিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে আইসিটি অনুবিভাগ। ইসির সিস্টেম ম্যানেজার মো. রফিকুল হক এক ইউও নোটে এ অর্থ সংস্থানের অনুরোধ জানান। সংশ্লিষ্ট শাখা জানিয়েছে, ট্যাব ও সফটওয়্যার কেনার মতো অর্থ বাজেটে সংস্থান করা হয়নি। আরও জানা গেছে, ৪২ হাজার ট্যাবের প্রতিটির দাম ১০ হাজার টাকা হিসাবে ৪২ কোটি টাকা, বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার কেনার জন্য ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং চার ধরনের সফটওয়্যার কেনার জন্য ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা সবমিলিয়ে ৪৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে এসব জিনিসপত্র কিনতে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/109057