৭ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:২৮

যমুনার ডুবোচরে আটকা পড়েছে বাঘাবাড়ী বন্দরমুখী ২৫টি জাহাজ

বাঘাবাড়ী বন্দর নৌপথের বেড়ার পেঁচাকোলায় নাব্যতা সঙ্কটে গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যবাহী ২৫টি কার্গোজাহাজ যমুনার ডুবোচরে আটকা পড়েছে। আটকে পড়া জাহাজের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। নাব্যতা সঙ্কট চরম আকার ধারণ করায় জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ পূর্ণ লোড নিয়ে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে পৌঁছাতে পারছে না। মাঝ নদীতে আটকে পড়া জাহাজ থেকে লাইটারেজ করে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পণ্য বাঘাবাড়ী বন্দরে আনা হচ্ছে। বিআইডাব্লিউটিএ সময়মতো ড্রেজিং শুরু না করায় নাব্যতা সঙ্কট চরম আকার ধারণ করছে।

বেড়া পেঁচাকোলায় মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও মংলা বন্দর থেকে বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা এমভি জুয়েল, এমভি ফেয়ারী-৫, ওটি আছিয়া বেগম, এমভি সুমাইয়া হোসেন, এমভি ফয়সাল-৪, এমভি ফয়সাল-৬, এমভি ফয়সাল-৮, এমভি ইব্রাহীম খলিল-১, জুয়েল-১, আল তায়েফ, এমভি আফিফা, এমভি ওয়ারিশ আহনাফ, সততা পরিবহন, মাজননী, বিসমিল্লাহ, আছিয়া পরিবহন, ভাই ভাই, আবু ছালে, এমভি জুয়েলসহ ২৫টি জাহাজ পেঁচাকোলার বিভিন্ন পয়েন্টে যমুনার ডুবোচরে আটকা পড়েছে। কার্গোজাহাজগুলো জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সার, কয়লা, গম ও চাল নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে যাচ্ছিল। এর আগে ২ নভেম্বর ১০ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে এমভি চিলিং বিজয় জাহাজ ডুবোচরে আটকা পড়ে। এদিকে পেঁচাকোলার উজানে ১৫-১৬টি ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় ভাটিতে ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ যমুনা নদীতে ড্রেজিং না করায় আটকে পড়া জাহাজের সংখ্য বাড়ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
বাঘাবাড়ী বন্দর সূত্রে জানা যায়, দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌপথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে উত্তরাঞ্চলে চাহিদার ৯০ শতাংশ জ্বালানি তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে বাঘাবাড়ী বন্দরের মাধ্যমে চাল ও গমসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। এ নৌপথের ১০টি পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে।
বিসিআইসির বাঘাবাড়ী ট্রানজিট বাফার গুদাম সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের ১৪টি বাফার গুদামে রাসায়নিক সার চাহিদার ৯০ শতাংশ বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে জোগান দেয়া হয়। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা রাসায়নিক সার সড়ক পথে বাফার গুদামগুলোতে সরবরাহ করা হয়। যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটে বাফার গুদামগুলোতে আপৎকালীন সারের মজুদ গড়ে তোলার কাজ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে।

বিসিআইসির বগুড়া আঞ্চলিক অফিস সূত্রে জানা যায়, ইরি-বোরো আবাদ মওসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ১২ লাখ টন রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় সারের বেশির ভাগই বাঘাবাড়ী বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়, পরে সেখান থেকে সড়ক পথে বাফার গুদামে পাঠানো হয়। বাফার গুদামগুলোতে আপৎকালীন মজুদ আছে দুই লাখ ৮০ হাজার টন। যমুনা নৌরুটে নাব্যতা সঙ্কট হওয়ায় আপৎকালীন সার মজুদের কাজ কিছুটা বিঘিœত হচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অফিসের একটি সূত্রে জানা যায়, রাসায়নিক সার ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য ১০-১১ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়। বর্তমানে এ নৌপথে কোথাও কোথাও ৮ থেকে ৯ ফুট পানির গভীরতা রয়েছে। আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে পানির স্তর কমে ৭ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা।
বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত নৌপথের মোহনগঞ্জ, হরিরামপুর, চরসাফুল্লা, নাকালিয়া, পেঁচাকোলা, নাকালী, নগরবাড়ীসহ ডজনখানেক পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মোহনগঞ্জ পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে মোহগঞ্জ, হরিরামপুর ও নাকালী পয়েন্টে ডুবোচরে পণ্যবাহী জাহাজ মাঝে মধ্যে আটকা পড়ছে।
বাঘাবাড়ী নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বাঘাবাড়ী থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার নৌপথের মোহনগঞ্জ, পেঁচাকোলা, হরিরামপুর, কল্যাণপুর, চরসাফুলা, চরশিবালয়, নাকালী ও রাকশাসহ ১০টি পয়েন্টে পানির গভীরতা কমে ৭ থেকে ৯ ফুটে দাঁড়িয়েছে। কয়েক স্থানে সরু হয়ে গেছে নৌ-চ্যানেল। বাঘাবাড়ী নৌবন্দর কতৃপক্ষ ড্রেজিংয়ের জন্য বিআইডাবিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। বাঘাবাড়ী বন্দরমুখী রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যবাহী কার্গোজাহাজ পূর্ণ লোড নিয়ে বন্দরে পৌঁছাতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ড্রেজিং শুরু না করায় নাব্যতা সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

এমভি চিলিং বিজয়ের মাস্টার হেলাল উদ্দিন জানান, দৌলতদিয়া থেকে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার নৌপথের ১০টি পয়েন্টে পানির গভীরতা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ থেকে ৯ ফুট। সরু হয়ে গেছে নৌচ্যানেল। মোহনগঞ্জ পয়েন্টে কার্গোজাহাজ চলাচলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ পয়েন্টে দু’টি জাহাজ পাশাপাশি চলাচল করতে পারছে না। ওই পয়েন্টে জেগে উঠা চরের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন চ্যানেলটি আরো সরু হয়ে যাচ্ছে। এই পয়েন্টে দ্রুত ড্রেজিং না করা হলে পণ্যবাহী ও জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন তিনি।
বিআইডাব্লিউটিএ আরিচা অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই এ সময় দৌলতদিয়া থেকে বাঘাবাড়ী নৌপথে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দেয়। বর্তমানে এ রুটে ৭ থেকে ৮ ফুট পানির গভীরতা রয়েছে। নৌচ্যানেল সচল রাখার জন্য যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজিং শুরু করা হবে। জাহাজগুলো অতিরিক্ত মালামাল বহন করায় ডুবোচরে আটকা পড়ছে। এ ছাড়া পেঁচাকোলা ও মালদাহপাড়ার মাঝে যমুনা নদীতে ডুবোচর জেগে ওঠায় নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

 বিপিসির বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপোর যমুনা কোম্পানির ম্যানেজার এ কে এম জাহিদ সরোয়ার জানান, বাঘাবাড়ীতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোতে ৭ কোটি লিটার জ্বালানি তেল মজুদ আছে। আরো প্রায় ৭৪ লাখ লিটার ডিজেল ভর্তি ১২টি জাহাজ চিটাগাং থেকে বাঘাবাড়ী বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে এসেছে। নগরবাড়ীর উজানে ৪৯ লাখ লিটার জ্বালানি তেলবাহী চারটি জাহাজ যমুনা নদীতে আটকা পড়েছে। নাব্যতা সঙ্কটে জাহাজগুলো বন্দরে আসতে পারছে না। আটকে পড়া জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল লাইটারেজ করে বাঘাবাড়ী ডিপোতে আনা হচ্ছে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সঙ্কটের আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/362870