৭ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:২৭

প্রাণিজ আমিষের জোগানদাতা খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত

অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতায় দেশের ৪২ শতাংশ কিশোরী অপুষ্টিতে ভুগছে। সমায়ের ব্যবধানে এরাই মা হচ্ছেন, জন্ম দিচ্ছেন অপুষ্ট নাগরিক। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের সময়ের সাথে তুলনা করলে দেশের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো সবার শীর্ষে। এসব তথ্য এসেছে জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত জরিপ থেকে। জরিপে এসেছে আশা জাগানিয়া তথ্যও। ২০১০ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক ডিমের ব্যবহার ছিল ৭ দশমিক ২০ গ্রাম। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ৮৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৮ গ্রাম।

জরিপের ফলে দেখা যায়, ওই মেয়াদে গরুর গোশতের ব্যবহার ১০ শতাংশ ও মাছের ব্যবহার বেড়েছে ২৬ শতাংশ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির সময় বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পোলট্রি খামারের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়টি। সময়ের ব্যবধানে এ সংখ্যা লাখ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এখন এ শিল্পের সাথে জড়িত, যাদের ৪০ শতাংশই নারী। একটা সময় ছিল বাচ্চা ও খাবারের জন্য দেশী খামারগুলো নির্ভরশীল ছিল বিদেশীদের ওপর। বর্তমানে মুরগির ডিম, গোশত, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং খাবারের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছেন দেশী খামারিরা। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের তুলনায় কম মূল্যে ডিম ও মুরগির গোশত খেতে পারছেন এ দেশের মানুষ। দেশে তৈরী পোশাক শিল্পের পর সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে পোলট্রি শিল্প। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে এ শিল্প। এ দেশের কৃষকের শ্রমে-ঘামে তিলে তিলে গড়ে ওঠা আমদানিনির্ভর পোলট্রি শিল্প এখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে রফতানি বাণিজ্যের। যদিও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যাপক কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন ও সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অভাবনীয় অবদান রক্ষাকারী সম্ভাবনাময় পোলট্রি শিল্পখাত এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত।
বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞ ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে এখনো পর্যন্ত পোলট্রি শিল্পের ওপর কার্যকর কোনো জরিপ পরিচালিত হয়নি। ফলে ঠিক কত সংখ্যক লোক এ পেশায় সরাসরি জড়িত এবং বছরে কয়টি খামার বন্ধ হচ্ছে, কী কারণে বন্ধ হচ্ছে, কয়টি নতুন খামার চালু হচ্ছে, কী পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, কত সংখ্যক উদ্যোক্তা পুঁজিহারা হচ্ছেন, কতজন লাভবান হচ্ছেনÑ তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি কোনো সংস্থা থেকেই। এ শিল্পের উদ্যোক্তা এবং জনশক্তির প্রশিক্ষণে কোনো কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। কিন্তু বছর বছর শুল্ক বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক হয়রানির অভিযোগ শোনা যায় সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে।

কিন্তু সরকারের কিছু পদক্ষেপে সম্ভাবনাময় এ খাতে নেমে এসেছে অন্ধকার। অভিযোগ রয়েছে, ২০২৫ সাল পর্যন্ত এ খাতকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের কর থেকে অব্যাহতি দেয়ার আরজি সরকারের বিবেচনায় আসেনি। দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী, প্রোটিন ও আমিষের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে রোগমুক্ত সুস্থ জাতি গঠনের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রচারণা চালানোর উদ্যোগও নেয়নি সরকার। ভ্যাটমুক্ত করা হয়নি এ সংক্রান্ত প্রচারণা। উল্টো নতুন নতুন শুল্ককর আরোপ করে শিল্পকে দুর্বল করা হচ্ছে। একের পর এক প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে উৎপাদন খরচ ও পণ্যের দাম।

বিচ্ছিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার ছোট-বড় খামার আছে। জিপি খামার আছে সাত কোম্পানির ১৫টি। পিএস খামার আছে ২০৫টি। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে রেজিস্টার্ড ফিড মিল সংখ্যা ১৫০টি হলেও অনিবন্ধিত আছে ১২৮টি। বর্তমানে মুরগির গোশতের দৈনিক উৎপাদন প্রায় চার হাজার টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ পিস। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ। বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এখাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার গড়ে প্রায় ১৫-১৮ শতাংশ। জিডিপিতে পোলট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ১.৫ শতাংশ।

অন্য দিকে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ডিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং গৃহপালিত মুরগি, হাঁস ও কোয়েল পাখির ডিম হিসাব করলে দৈনিক গড় উৎপাদন ৪ কোটি ৭১ লাখের ওপরে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৬৬৫ কোটি পিস। এর মধ্যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে ডিমের মোট উৎপাদন হয়েছে ৪৩৩ কোটি পিস। স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে বেশি করে ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে দেশের অপুষ্টির চিত্র আমূল পাল্টে যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবেশবাদীদের পাশাপাশি এ খাতের উদ্যোক্তাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ পোলট্রিতে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। শত সাবধানতা ও বায়োসিকিউরিটি মেনে পোলট্রি উৎপাদন করেও নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ গতানুগতিক বাজারব্যবস্থা। আমাদের দেশের মানুষ বাজার থেকে জীবন্ত মুরগি কিনতেই পছন্দ করেন। অথচ বাজারগুলোর ব্যবস্থাপনা অরক্ষিত ও নিম্ন মানের। ওয়েটমার্কেটগুলো নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা এবং ওয়েটমার্কেট থেকে ক্রমান্বয়ে জীবন্ত মুরগি বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা বাড়লেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
বিপিআইসিসি হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের চাহিদা মেটাতে হলে প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ ডিম অর্থাৎ বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডিম উৎপাদন করতে হবে। মুরগির গোশত উৎপাদন করতে হবে দৈনিক পাঁচ হাজার ৪৮০ টন অর্থাৎ বছরে প্রায় ২০ লাখ টন। এজন্যে পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ করতে হবে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বর্তমান বিনিয়োগের সাথে নতুন করে যুক্ত করতে হবে আরো ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা। কারণ ডিম-মুরগি ছাড়াও এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে বাচ্চা উৎপাদন, মুরগির খাবার, ওষুধ, কাঁচামাল ও সংশ্লিষ্ট সেবা খাত।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্র্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে জানান, বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্প বেশ কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ শিল্পে সরকারের দেয়া কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেয়া হয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে, রোগ-জীবাণুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে ডিম ও মুরগির গোশতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়ার সাথে যদি পণ্যের দাম বাড়ত তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না কিন্তু উল্টোটা হয়েছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে ডিম ও মুরগির গোশতের দাম কমে গেছে।
তিনি আরো বলেন, গত প্রায় এক বছর ডিমের দাম উৎপাদন খরচের চেয়েও কম ছিল। ফলে খামারিরা ডিম পাড়া মুরগিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ সময়কালে অনেকেই খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। যার কারণে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে সরকারের সহযোগিতা দরকার। খামারিরা ডিম ও মুরগির গোশতের নায্যমূল্য না পাওয়ায় লোকসানে পড়ছেন। ফলে পোলট্রি ব্যবসার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। ডিলারেরা খামারিদের কাছে বাকিতে দেয়া ফিডের টাকা তুলতে পারছেন না, যার প্রভাবে ফিড মিলগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের চাপ বাড়ছে, লোকসানে পড়ছেন মিল মালিকেরা। খামারিরা লোকসানে পড়ায় নতুন করে বাচ্চা তুলছেন না; উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে বাচ্চা বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে ব্রিডার ও হ্যাচারিদেরও ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। তবে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ নয়া দিগন্তকে জানান, ভোক্তার চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের উৎপাদন ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনোভাবেই যেন উৎপাদন কিংবা জোগানে ঘাটতি তৈরি না হয়; সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, চাহিদাকে আমরা দু’ভাবে দেখি। এক. প্রোটিন চাহিদার হিসাবে ডিম ও গোশতের চাহিদা এবং দুই. ক্রয়ক্ষমতার বিচারে চাহিদা। প্রোটিন চাহিদার বিচারে বছরে মাথাপিছু ন্যূনতম ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার সেখানে আমরা খাচ্ছি বেসরকারি হিসাবে ৭০টির মতো। আর সরকারের হিসাবে ৯০টির ওপরে। মুরগির গোশত খাচ্ছি বছরে প্রায় ৬.৩ কেজি; যেখানে অনেক দেশেই এ পরিমাণ ৪০-৪৫ কেজি। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে চাহিদার প্রকৃতি অনেকটাই ক্রয়ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। তাই ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারলে ডিম ও গোশতের মাথাপিছু কনজাম্পশন বাড়বে। লোপ্যাথজনিক এইচ৯এন২ ভাইরাসের কারণে উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, অজ্ঞাত কারণে এ ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না।

পোলট্রি উৎপাদনে প্রায় ৬০ শতাংশ ফিডে খরচ হয় জানিয়ে খালেদ বলেন, গত তিন বছরে পোলট্রি ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ও করের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আমাদের দেশের বন্দরে ফিডের জন্য কোনো সাইলো নাই, বন্দর ব্যবস্থাপনা খারাপ হওয়ার কারণে বিদেশী জাহাজগুলো আমাদের অনেক বেশি চার্জ করছে। আগে ২০ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা যেত একটি ট্রাকে; কিন্তু নতুন আইন হওয়ায় এখন এক ট্রাক পণ্য পরিবহনে দুইটি ট্রাক ভাড়া করতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদার হার বেড়েছে। সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে, তাই বেসরকারি পর্যায়েও এ চাপ বেড়েছে। অর্থনীতির সহজ সমীকরণে উৎপাদন খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে। যেহেতু আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় সীমিত, তাই চাইলেই পণ্যের দাম বাড়ানো যায় না। সে কারণেই সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম ও মুরগির গোশতের সরবরাহ কিভাবে নিশ্চিত করা যায়; সে দিকে আমাদের নজর দিতে হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্প যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়াতেই হবে। কারণ এটি খাদ্যের জোগান দিচ্ছে, প্রোটিনের চাহিদা মেটাচ্ছে, স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনে ভূমিকা রাখছে, কর্মসংস্থান করছে, দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে, সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। একই সাথে আগামীতে আরো বেশি অবদান রাখবে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/362844