৫ নভেম্বর ২০১৮, সোমবার, ১২:২৮

ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে : প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। কিন্তু ওই ঋণ আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দেয়া যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আদায় কমে যাচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা। যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তাদের চলতি ঋণেরও জোগান দেয়া যাচ্ছে না। ফলে তাদের অন্য ব্যবসায়ও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে। কমে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রকৃত আয়।
অন্য একটি ব্যাংকের রামপুরা শাখায় বিনিয়োগ বিভাগের দায়িত্বে আছেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, আগে ওই শাখা থেকে নানা খাতে বিনিয়োগ দেয়া হতো। বিশেষ করে মাঝারি মানের ব্যবসায়ীদের চলতি মূলধনের জোগান দেয়া হতো। কিন্তু গত প্রায় সাত-আট মাস ধরে ঋণ কার্যক্রম বলা চলে বন্ধ রয়েছে। প্রধান কার্যালয় থেকে বিনিয়োগের চেয়ে আমানত সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। আগে শাখা থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠালেই তা অনুমোদন করা হতো। এখন আর তা সহজে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। ফলে যারা নিয়মিত বিনিয়োগ নিয়ে ব্যবসায় করতেন তাদের নতুন করে বিনিয়োগ না দেয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তারা আগে যে পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়েছিল ব্যাংককে তা ফেরত দিতে পারছে না। আর নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। সব মিলে সংশ্লিষ্ট শাখার আয় কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হলে চলতি বছর শেষেই লোকসান গুনতে হবে।

আলোচ্য ব্যাংক দু’টির মতো বেশির ভাগ ব্যাংকেরই একই অবস্থা বিরাজ করছে। প্রকৃত আদায় কমে যাওয়া বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। নানা উপায়ে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। একদিকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, পাশাপাশি কমছে ব্যাংকের প্রকৃত আদায়। খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে বেশি হারে। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৩০টি ব্যাংকের প্রকৃত আয় আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশের বেশি কমে গেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো ব্যাংকের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে আয়।

এদিকে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ সক্ষমতা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক বিনিয়োগের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র এক দশমিক ২৪ শতাংশ, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তারা আছেন মহাবিপাকে। কারণ, একদিকে প্রধান কার্যালয় থেকে মুনাফার টার্গেট দেয়া হচ্ছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ও আমানত কমে যাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। কাক্সিক্ষত হারে মুনাফা করতে না পারায় ব্যর্থতার দায় দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত জুন শেষে অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার ২১০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগে কর্মরত আছেন এমন একজন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় বড় শিল্পগ্রুপ ঋণ পরিশোধ করছেন না। আবার তাদের ঋণও নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যে শাখাতেই পরিদর্শনে যাওয়া হচ্ছে ওই শাখাতেই খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না। এভাবেই প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র বের হচ্ছে না।
তবে সামগ্রিক খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকই নগদ টাকার সঙ্কটে রয়েছে। এতে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তহবিল কমে গেছে। বছরখানেক আগেও যেখানে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল সোয়া লাখ কোটি টাকা, সেটি এখন কমে নেমেছে ৭৫ হাজার কোটি টাকায়, যার বেশির ভাগই সরকারি কোষাগারে ট্রেজারি বিল ও বন্ড আকারে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত আগস্ট শেষে ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম তারল্য সংরক্ষণের কথা ছিল প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু ব্যাংকগুলোর তারল্য রয়েছে দুই লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের কোষাগারেই বিল ও বন্ড আকারে রয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ফলে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার যে উদ্বৃত্ত তারল্য দেখানো হচ্ছে তার বেশির ভাগই ব্যাংকগুলোর হাতে নেই। এমনই অবস্থায় পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা দিন দিন খারাপ অবস্থানে চলে যাবে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/362473