৬ নভেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১২:১১

অনিবার্য কারণ ও জেএসসি পরীক্ষা

মোঃ এমদাদ উল্যাহ : জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা নিয়ে আবারও শুরু হয়েছে টালবাহানা। ৪ নভেম্বর রোববারের পরীক্ষা ‘অনিবার্য কারণ’ দেখিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই অনিবার্য কারণ কি বুঝছে না পরীক্ষার্থীরা। স্থগিত হওয়া এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৯ নভেম্বর শুক্রবার সকাল নয়টায়। ওইদিন জেএসসিতে ইংরেজি, ইংরেজি প্রথম পত্র (অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য) এবং জেডিসিতে আরবি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা হবে।

২০১৫ সালে বিরোধী জোটের আন্দোলনের কারণে পাবলিক পরীক্ষাগুলো বারবার পিছিয়ে দিতে হয়েছে। পিছিয়ে দেয়া পরীক্ষাগুলো বেশির ভাগ অনুষ্ঠিত হয়েছে শুক্রবার। তখন ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয় বিরোধী জোট। কিন্তু এখন কোন আন্দোলন না থাকলেও ‘অনিবার্য কারণ’ উল্লেখ করে পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরীক্ষার্থী, তাদের স্বজন ও শিক্ষাবিদরা বিরূপ মন্তব্য করেছেন। ফেসবুকে একজন উল্লেখ করেন, ‘একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা উপলক্ষে পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। তাতে লুকোচুরি করার কি আছে? পরীক্ষার্থীরা এই ‘অনিবার্য কারণ’ থেকে কি শিখবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়ার আহবান জানান অনেকে। কেউ কেউ লিখেছেন-জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার্থী পৌনে ২৭ লাখ। কিন্তু সমাবেশে তো এ পরিমাণ কওমি আলেম ও শিক্ষকরা উপস্থিত হবে না। তাহলে কেন পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হলো। সমাবেশ পিছিয়ে দিলে কি হতো?

শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বাসায় সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এনিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সন ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমূল হক খান সাংবাদিকদের নিকট পরীক্ষা স্থগিতের কারণ ‘অনিবার্য’ হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু সাংবাদিকরা এর কারণ হিসেবে ৪ নভেম্বর রোববার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের ‘শুকরানা মাহফিল’-এ লোক সমাগম বেশি করাকেই উল্লেখ করেছে। এদিন ঢাকাসহ সারাদেশের কওমি মাদরাসার কয়েক লাখ মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হবেন। এ জন্য ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে ওই এলাকার পরীক্ষার্থীদের আগে-ভাগেই কেন্দ্রে আসতে বলা হয়েছিল। মুলত; কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের স্বীকৃতি দিয়ে আইনের অনুমোদন দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্যই কওমি আলেমদের এ শোকরানা মাহফিল। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভাপতিত্ব করবেন আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমেদ শফি(দাঃ বাঃ)।

এর আগে গত ১৩ আগস্ট সোমবার কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের স্বীকৃতি দিয়ে আইনের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ওইদিন রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, কওমি মাদরাসার ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটির নাম ‘কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’। এ নিয়ে ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। এতে কওমি মাদরাসার শুধু দাওরায়ে হাদিস পাস শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের ডিগ্রি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে কওমি মাদরাসার ছয়টি বোর্ড রয়েছে। এই ছয়টা বোর্ডের সমন্বয়ে ঢাকায় একটি কমিটি হবে। কমিটির সদস্য সংখ্যা হবে ১৫। ছয় বোর্ড থেকে দুজন করে কমিটিতে থাকবেন। এ ছাড়া একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন মহাপরিচালক থাকবেন। এই কমিটিই সনদ প্রদান করবে। মোহাম্মদ শফিউল আলম আরও বলেন, প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে যারা দাওরায়ে হাদিস পাস করেছে, তারাই মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের সনদ পাবে।

গত ১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার শুরু হয় এ বছরের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। এক বিষয় পরীক্ষা দেয়ার পরই রুটিন পরিবর্তন করাকে ভালোভাবে দেখছে না পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সারাদেশে এবার ২৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের জানানো তথ্য অনুযায়ী দেশের ২৯ হাজার ৬৭৭টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ১ থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৯০৩টি কেন্দ্রে জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এবার জেএসসি-জেডিসির ২৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৬০১ জন ছাত্রী এবং ১২ লাখ ২৩ হাজার ৭৩২ জন ছাত্র। এবার ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৮৬৯ জন। আট বোর্ডের অধীনে এবার জেএসসিতে ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৪৩ জন এবং মাদরাসা বোর্ডের অধীনে জেডিসিতে ৪ লাখ ২ হাজার ৯৯০ জন পরীক্ষা দিচ্ছে। এবার জেএসসিতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৫৩ জন এবং জেডিসিতে ৩৪ হাজার ২৫১ জন অনিয়মিত পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে। এক থেকে তিন বিষয়ে যারা অকৃতকার্য হয়েছিল তারাও এবার ওইসব বিষয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, এই সংখ্যা জেএসসিতে ২ লাখ ৩০ হাজার ৭৮৫ জন এবং জেডিসিতে ৩০ হাজার ৫৪৮ জন। বিদেশের নয়টি কেন্দ্রে এবার ৫৭৮ জন জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এবারও বাংলা দ্বিতীয়পত্র, ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয়পত্র ছাড়া অন্য বিষয়ের পরীক্ষা সৃজনশীল প্রশ্নে হচ্ছে।

২০১৫ সালে বিশ দলীয় জোট সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে প্রথম দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত করলেও পরবর্তীতে পরীক্ষা চালিয়ে যায়। তখন পত্রিকা ও টেলিভিশন টকশোতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বরত ব্যক্তি এবং শিক্ষাবিদরা বলেছিলেন-‘আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের কর্ণধার। তারাই দেশের নেতৃত্ব দিবে। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতেই বিরোধী জোট আন্দোলন করছে বলে তখন অনেকেই অভিযোগ তুলেন’। এবার পৌনে ২৭ লাখ শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা না করেই পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে মন্তব্য করছেন- শোকরানা মাহফিলে বেশি লোকের সমাগমের ইমেজ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে কাজে লাগাবে ক্ষমতাসীন আ’লীগ।
ঢাকায় অবস্থানরত মুহাম্মদ আবদুল্লাহ নামের একজন সিনিয়র সাংবাদিক তার ব্যবহৃত ফেসবুকে শনিবার স্ট্যাটাস লিখেন-‘২৬ লাখ ৭০ হাজার কিশোর শিক্ষার্থীকে এমন বিপদে না ফেললে কি হতো না? আগামীকালের পরীক্ষা পেছানোর কারণে এখন জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার্থীদের কোন বিরতি ছাড়াই ইংরেজি, অংক ও বিজ্ঞানের মত কঠিন তিনটি বিষয়ে টানা পরীক্ষা দিতে হবে। এতে প্রস্তুতিতে প্রচন্ড চাপে পড়তে হবে তাদের। আমার পরিচালনাধীন স্কুলের জেএসসি পরীক্ষার্থীর এক অভিভাবক উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়ে ফোন করলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কওমি বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে (শুকরানা মাহফিল) রোববার সারা দেশ থেকে লোক আসবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে। বাংলা নিউজের খবরে এ কথা জানানো হয়েছে। এ ধরনের অতি উৎসাহী কান্ড কি খুব অপরিহার্য ছিল? এটি একটি খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে’।

আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন-‘শুকরিয়া মাহফিলের জন্য জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে। আশা করা যায়-আন্দোলনের জন্যও (যদি হয়) পেছাতে সমস্যা হবে না’।
পর্যালোচনা করে বুঝা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থেই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করে। নিজেদের বিরুদ্ধে গেলে তখন সঠিকটা বারবার উচ্চারণ ও নিয়মের বুলি সাধারণ মানুষকে শোনানো হয়। আর নিয়ম ভেঙে নিজেরা কাজ করলে সেটা দেশের স্বার্থে উচ্চারণ করা হয়। এক কথায়-সব ভোগান্তি সাধারণ মানুষের।

http://www.dailysangram.com/post/352156