৩১ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১১:৩৪

বিভ্রান্ত তথ্যে শ্রমিকদের রাস্তায় নামান নেতারা

কর্মবিরতির নামে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে দেশে উত্তাপ ছড়াতেই যাত্রী ও রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামা চালকদের হেনস্তার কৌশল নিয়েছিল কর্মসূচি আহ্বানকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। ধর্মঘটকালে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে দুই নবজাতক শিশুর মৃত্যুর দায় নিতে চাইছে না এই ফেডারেশন। এদিকে শ্রমিকদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটের সময় মানুষের মুখে কালি মাখানোর ঘটনাকে ‘জঘন্য’ কাজ বলে উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এসব ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।

বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্মসূচি সফল করার জন্য পরিকল্পনা করেই সাধারণ পরিবহন শ্রমিকদের খেপিয়ে রাস্তায় নামান ফেডারেশনের নেতারা। তাদের মধ্যে প্রচার করা হয়, দুর্ঘটনা ঘটলে চালকের মৃত্যুদণ্ড হবে। যদিও নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত হলে বা কারো প্রাণহানি হলে চালকের সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী শাস্তি অর্থাৎ সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড তখনই দেওয়া হতে পারে—যদি তদন্তে দেখা যায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চালক বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতারা সাধারণ পরিবহন শ্রমিকদের আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে প্রচার করেন—নতুন আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল গুলশানে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের এক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘শ্রমিকদের ধর্মঘট চলাকালে তারা (শ্রমিকরা) জঘন্য কাজ করেছে।

আমাদের ছেলে-মেয়েদের কালি মেখে দিয়েছে। আমি মনে করি, তারা এই জঘন্য কাজটি করে মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আন্দোলনের নামে রাস্তায় যারা মানুষের হয়রানি করেছে, যারা অন্যের মুখে কালি মেখেছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হবে। তাদের নামে মামলা হবে।’ একটি সূত্র জানায়, এরই মধ্যে ফেসবুকের ছবি ও গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবি থেকে দায়ী শ্রমিকদের শনাক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে।

প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি পড়েনি অনেক পরিবহন শ্রমিক। তাদের অনেকে আবার পড়তেও জানে না। এই সুযোগে নেতারা মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি বেশি প্রচার করে তাদের খেপিয়ে তোলেন। ধর্মঘট চলাকালে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে অনেক শ্রমিককে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা ফাঁসির দড়ি গলার সামনে নিয়ে গাড়ি চালাব না।’
রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ধর্মঘটকালে ছক তৈরি করা হয় যাত্রী হেনস্তার। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২৭ অক্টোবরই রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিজ্ঞা করেন পরিবহন নেতারা। ফেডারেশনে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে ওই সমাবেশে নেতারাও বলতে থাকেন, ‘ফাঁসির রশি মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাব না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধর্মঘট আহ্বানকারী সংগঠনের বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাই মাঠে নেমে যাত্রীদের হেনস্তা ও ব্যক্তিগত গাড়ি আটকানোয় ইন্ধন দেন। গাবতলীতে ফেডারেশনের আদিষ্ট হয়ে স্থানীয় পরিবহন নেতা আতিক আব্বাস; গুলিস্তান, মতিঝিল, খিলগাঁও, কমলাপুরে ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মোখলেছুর রহমান; সায়েদাবাদে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করম আলী, ময়মনসিংহে জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নজরুল ইসলাম, সিলেটে ফেডারেশনের কার্যকরী সদস্য সেলিম আহমদ ফলিক, খুলনায় ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুর রহিম বক্স দুদু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। এসব পরিবহন নেতাই ছিলেন কর্মসূচির ইন্ধনদাতা। তবে এই নেতারা প্রকাশ্যে অভিযোগ অস্বীকার করেন। যেমন—ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুর রহিম বক্স দুদু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কর্মবিরতি পালন করেছি। যাত্রী ও চালকদের হেনস্তা করতে বলিনি।’
ঢাকায় ধর্মঘটকালে ৫০০ অটোরিকশা ভাঙচুর ও শতাধিক চালককে মারধর করা হয়। খিলগাঁও, মুগদা, বিশ্বরোডসহ বিভিন্ন এলাকায় এই নৈরাজ্যে ইন্ধন দিয়েছিলেন ঢাকা জেলা ফোরস্ট্রোক অটোরিকশা ড্রাইভার্স ইউনিয়নের নেতারা। এই ইউনিয়ন ধর্মঘট আহ্বানকারী ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। রাজধানীর দোলাইরপাড়ে ভাঙচুর ও যাত্রী হয়রানিতে নির্দেশনায় ছিলেন ঢাকা জেলা অটোরিকশা মিশুক চালক শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হাবিবুর রহমান ও শেখ রাজ্জাক। অভিযুক্তদের অনেকে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি নয়।

আইন অমান্য করে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে ৪৮ ঘণ্টা ধরে নৈরাজ্য চালিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। গত রবি ও সোমবার রাজধানীসহ সারা দেশে সাধারণ চালক, যাত্রী ও পথচারীদের তারা হেনস্তা করেছে গালে, মুখে ও পোশাকে কালি মাখিয়ে। নাগরিক ও শিক্ষার্থীরা গত সোমবার রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলেও হেনস্তার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি পুলিশকে। এ অবস্থায় ধর্মঘট আহ্বানকারীরা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে আগামী ৩ নভেম্বর নোটিশ পাঠাচ্ছে। ৩ নভেম্বর থেকে ২১ দিনের মধ্যে সড়ক পরিবহন আইনের ধারা সংশোধন না হলে আবার ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘট আহ্বান করবে তারা।

ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সরদার মো. সোবহান ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ (খোকন) কালের কণ্ঠকে বলেন, সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকরা তথাকথিত ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করে রাস্তায় চলাচল স্বাভাবিক রেখে যাত্রী সাধারণের সেবায় নিয়োজিত ছিল। রাজধানীর শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, দোলাইরপাড়, জুরাইন, সায়েদাবাদ, বাসাবো, খিলগাঁও, মিরপুর-১৪, আনসার ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে তথাকথিত ঢাকা জেলা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতাদের ইন্ধনে শ্রমিকদের মারধর, যাত্রী সাধারণের গায়ে পোড়া মবিল নিক্ষেপসহ অপ্রীতিকর ঘটনা সৃষ্টিকারীদের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ধর্মঘটে অ্যাম্বুল্যান্স চলতে দেওয়া হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হরতালেও। কিন্তু এবার দেওয়া হলো না। এটা নৈরাজ্য, এর দায় নিতে হবে ধর্মঘট পালনকারী সংগঠনের।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি বানচাল করতে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী পরিবহন সংগঠনগুলো যাত্রীদের হেনস্তা করেছে। আমরা অবশ্য ধর্মঘটকালে হেনস্তা করায় একজন সদস্যকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছি।’
গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কারো পথ আটকে দেওয়া এবং মুখে কালি দেওয়া ফৌজদারি অপরাধ। তবে এ অপরাধ যার সঙ্গে সংঘটিত হয়েছে মূলত তাকে অভিযোগ দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ছবি ছড়িয়ে পড়লেও কোনো ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি বলেও দাবি করেন তাঁরা। অভিযোগ পেলেই মামলা হবে বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান গতকাল বলেন, ‘মুখে কালি মাখানো বা এ জাতীয় হয়রানির কোনো অভিযোগ এখনো পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/10/31/697964