২ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১১:১৯

বাণী তাঁর অমৃত সমান

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে যখন ছাত্রসমাজ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। আর দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় দলের কয়েকজন মন্ত্রীর মদদে শাহবাগে কিছু তরুণ কোটা প্রথা বহাল রাখার জন্য আন্দোলন শুরু করে। সংখ্যায় তারা অতি অল্প ছিল। কিন্তু তাদের দাবি হালে পানি পায়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যদি দাবি আদায় করতে হয়, তাহলে তোমরা আন্দোলন কর। আন্দোলন করলে তোমাদের দাবী মেনে নেয়া হবে। এ বক্তব্য অভিনব। কারণ এর আগে কোনো প্রধানমন্ত্রী দেশে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের আহ্বান কখনো জানায়নি। এরপর আমরা দেখতে পেলাম, কোটার পক্ষে কয়েকজন তরুণ শাহবাগের মোড়ে বসে পড়ল। পুলিশ ওই কয়েকজন তরুণের দাবির প্রতি সরকারের সমর্থনের প্রতীক হিসেবে শাহবাগের মোড় বন্ধ করে দিল। এভাবে চলতে থাকলো। সরকার হয়তো ভেবেছিল, এই তরুণদের সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের মত হাজার হাজার মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করতে আসবে। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে, কয়েকদিন ধরে ওই তরুণেরা শাহবাগ মোড়ে বসে থাকলেও মানুষের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। তা ছাড়া দেশের মিডিয়াও তাদের পক্ষাবলম্বন করেনি। করেনি লাইভ সম্প্রচার। অথচ নগরীর লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অবরোধের ফলে অপরিসীম ভোগান্তির শিকার হন। সরকার সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেনি। বরং তারা অপেক্ষায় বসে থাকল যে, কবে এখানে গণজাগরণ মঞ্চের মত জনসমর্থন সৃষ্টি হবে। সে পরিস্থিতি কখনো সৃষ্টি হলো না। সরকার অপেক্ষা করতে থাকলো, কবে আসবে সেই সুদিন। কিন্তু আন্দোলনের সুদিন এলো না। শেষ পর্যন্ত কোটা বহাল রাখার আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গেল।

সরকারের কি মতলব ছিল আমরা জানি না। কিন্তু সরকার ওই পদক্ষেপ ব্যর্থ হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কিছু তর তরুণ-তরুণীকে শাহবাগ মোড়ে এনে জড়ো করলো সরকার। ভাবখানা এমন যে, তারা নিজেরাই শাহবাগ মোড়ে এসে হাজির হয়েছেন উপজাতীয় কোটা রক্ষার জন্য। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল যে, আসলে তারা এ ধরনের কোন দাবি নিয়ে আসেন নেই।
উপজাতীয়দের নিয়ে যেসব এনজিও তৎপর এবং যারা সব সময় উপজাতীয়দের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেন, তারাও ওই আন্দোলনকে খুব একটা জোরদার করে তুলতে পারেননি। ফলে কয়েকদিন বসে থাকার পর ওই উপজাতীয় তরুণ-তরুণীরা শাহবাগ ছেড়ে চলে যান। সরকারের আন্দোলনের আশা ভেস্তে যায়।

কিন্তু তারপরও সরকার থেমে থাকে না। তারা একের পর এক নানা কৌশলে আন্দোলন সৃষ্টি করার চেষ্টা করে উপজাতীয়দের দিয়ে আন্দোলন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর। সরকার সেখানে কিছু সংখ্যক প্রতিবন্ধীকে নিয়ে আসে। তারাও প্রতিবন্ধী কোটা রক্ষা করার দাবি জানাতে থাকে। এরাও সংখ্যায় ১০-১৫ জনের বেশি ছিল না কিন্তু যেহেতু সরকার চায়, সে কারণে পুলিশ এই কয়েকজন লোক নিয়ে শাহবাগের মোড় অবরোধ করে দেয়। শাহবাগের মোড় অবরোধ করার ফলে গোটা ঢাকা মহানগরী প্রায় অচল হয়ে পড়ে। এখানে আছে দুটি হাসপাতাল, আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আছে গোটা ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু এ সবের কোন কিছুর দিকেই সরকার মনোযোগ দেয় নি। তারা যেন কেন একটি আন্দোলন চায়, কি লক্ষ্যে তারা এই আন্দোলন চায় তা নিশ্চিত করা বলা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে একটা আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা কি যেন অর্জন করতে চায়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও শাহবাগের আন্দোলন জমে ওঠে না। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম, উপজাতীয় কোটা আর প্রতিবন্ধী কোটা আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। আজব ঘটনা এই যে, এসব আন্দোলন জমে না উঠায় যেন সরকার বিপন্ন বোধ করতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত দৃশ্যপটে চলে আসেন সরকারের অনেক বিতর্কিত মন্ত্রী পরিবহন শ্রমিকদের নেতা ও সাবেক জাসদ নেতা শাহজাহান খান। তিনি দৃশ্যপটে এসে নতুন এক আন্দোলনের সূত্রপাত করার চেষ্টা করছেন। এ আন্দোলন হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে।
গত ২৮ শে অক্টোবর পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক পরিবহন আইন রদ-এর জন্য সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দেয়। মনে হচ্ছে এবার আন্দোলন জমে উঠবে এবং সরকারের আশা পূরণ হবে। আগে যারা শাহবাগে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের আন্দোলনে কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ছিল না। তারা সরকারি মদতে ও সহায়তায় এক মোড় অবরুদ্ধ করে সেখানে সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনেন। তাতে ও মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে। পুলিশ তো তাদের সরিয়ে দেয়ই নি বরং তাদের পাহারা দিয়ে রেখেছে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়টা সরকার আমলেই নেয়নি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। পরিবহন শ্রমিকরা যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে লক্ষ লক্ষ নগরবাসীকে যেমন জিম্মি করে ফেলেছেন তেমনি তারা অন্য যানবাহন যেমন মাইক্রোবাস, কার, অ্যাম্বুলেন্স প্রভৃতি শকট-এর উপর যথেচ্ছ হামলা চালিয়েছেন। তারা যাত্রী ও চালকদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তাদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দিয়েছেন। পুরো গাড়ি মোবিল দিয়ে লেপ্টে দিয়েছেন। ছাত্রীদের বাস থামিয়ে তাদের গায়েও লেপ্টে দিয়েছেন পোড়া মবিল আর আলকাতরা। অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ায় তার ভেতরে মারা দিয়েছে দুগ্ধপোষ্য শিশু। এমনি সব চমৎকার কাজ করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এখন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সংসদ চলবে ২৯ তারিখ পর্যন্ত। তারপর আর সংসদ বসবে না। সে কথা মানতে নারাজ নৌপরিবহনমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পরিবহন শ্রমিক সংগঠন। তাদের বক্তব্য, সড়ক পরিবহন আইন আইনের বেশ কিছু ধারা বাতিল করতে হবে।

এটা কিভাবে সম্ভব যে একটি সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজ করছে। আমরা বুঝতে পারছি না আসলে এই সরকার কি চাইছে। পরিবহন শ্রমিকরা অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি করেছেন। সে অপরাধ সীমাহীন। অথচ আমরা সরকারকে এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখি নি। শহরে এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটলেই শত শত পুলিশ রাস্তায় টহল দিতে নেমে যায়। কিংবা বেধড়ক লাঠিপেটা করে। কিন্তু ২৮ তারিখ দেখলাম পুলিশের কোন টহল গাড়ি নেই। পরিবহন টোকাইরা নির্বিঘেœ সাধারণ মানুষের উপর পৈশাচিক নির্যাতন যেমন চালাচ্ছে, তেমনি বন্ধ করে দিয়েছে সকল যানবাহন। দুপুরের দিকে রাজধানীর প্রাইভেট কারগুলোও রাস্তা ছেড়ে চলে যায়। কে গাড়ির ঝুঁকি নেয়, জানমালের ঝুঁকি নেয়। ২৮ তারিখ কার্যত নগরে যেন হরতাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এর আগে আমরা শিশু ও তরুণ শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে দেখেছি। বিমানবন্দর সড়কে বাস চাপায় দু’ জন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর তারা রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করেছে। তাতে দেখা গিয়েছিল যে, মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি, ডিআইজি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের হয় যানবাহনের ফিটনেস নেই। না হয় নেই চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স। এই কিশোর-তরুণেরা যানবাহন, রিকশা, কার সারিবদ্ধভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করেছিল। অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে আগে যাবার জন্য পথ করে দিয়েছিল। সে সময়ও পরিবহণ শ্রমিকরা নিরব ধর্মঘট শুরু করেছিল। তা ছাড়া অবশ্য তাদের আর কোনো পথও ছিল না। কারণ তাদের যানবাহনের নেই কোনো ফিটনেস, চালকের নেই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স। সেই শিশু- কিশোরদের ওপর হামলা চালিয়েছিল পুলিশ, হেলমেট বাহিনী আর ছাত্রলীগ। আজকের পরিস্থিতি অবশ্য ভিন্ন। এত বড় জনভোগান্তিতেও সরকার একেবারে চুপ মেরে আছে। আশ্চর্য ঘটনা।

বিরোধী দলগুলোর তরফ থেকে গত পাঁচ বছরে এক দিনও হরতাল ডাকা হয়নি। মনে হয়, এতে সরকার হাফিয়ে উঠেছে। কেন তারা হরতাল ডাকছে না। বিস্ময় লাগে এখানে যে, সরকারই দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি চাইছে। শ্রমিকদের সংগঠন বলেছে, তারা সড়ক পরিবহন আইন এর বিশেষ ধারাগুলো বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। খবর দেখে মনে হল, এতে শ্রমিকদের যেমন, তেমনি মালিকদেরও সমর্থন রয়েছে। আর সমর্থন রয়েছে সরকারেরও। কারণ এই শ্রমিকদের নেতা সাবেক জাসদ শাজাহান খান। আর মালিকদের সংগঠনের নেতারাও সরকার দলের।
এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, শ্রমিকদের এই আন্দোলনে সরকারের সমর্থন না থাকলে তারা এ আন্দোলন করতে সাহস পেত না। প্রধানমন্ত্রী তো আন্দোলন চেয়েছিলেন এবং ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আন্দোলন করতে পারলে তিনি দাবি মেনে নেবেন। সেই সূত্র ধরেই এখন পরিবহন শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেছেন। আর এই আন্দোলনের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
তবে কি সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি সরকার বেপরোয়া? সরকার যদি মনে করে থাকে যে, সাধারণ মানুষ কি ভাবলো, কি মনে করলো, তাতে তাদের কিছুই আসে যায় না। তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু রাস্তাঘাটে কান পাতলেই শোনা যাবে যে, আগামী নির্বাচনে সরকার জনগণের ভোটের তোয়াক্কা সরকার করছে না। তারা ভাবছে, বিনা ভোটেই ছলে বলে কলে কৌশলে তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হবে। কিন্তু সব আশা কি সব সময় পূরণ হয়!

http://www.dailysangram.com/post/351541