২ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৫৮

এলসি খোলায় রেকর্ড

দেশে পণ্য আমদানিতে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খোলায় রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে প্রায় দেড় শ’ শতাংশ পর্যন্ত এলসি খোলা হয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে রেকর্ড হয়েছে। গত অর্থবছর এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। এর আগের বছর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশের কাছাকাছি। সে হিসাবে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪ গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি বৃদ্ধির অস্বাভাবিক প্রবণতা আগে কখনও দেখা যায়নি। দু’বছর ধরে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমদানির বিপরীতে যে পরিমাণ পণ্য আসার কথা, তা আসছে না। কিছু ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে পণ্য আসছে। যে পণ্য বা মেশিনারিজ আসছে, তার মূল্য তত নয়। এভাবেই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে। কারণ ছাড়া অস্বাভাবিক আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলেই অর্থ পাচার হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। নির্বাচনী বছর হওয়ায় বর্তমানে অর্থ পাচার হচ্ছে আরো বেপরোয়াভাবে। এ ছাড়া যাদের কাছে উদ্বৃত্ত টাকা আছে, তারা ওই অর্থ দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেন না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তাই তারা দেশে টাকা রাখতে চান না বলে মন্তব্য করেন।

এদিকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে বৈঠকে বলেন, আমি মনে করি না গত দু-এক বছরের মধ্যে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে।
সমপ্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি ‘ত্বরিত মূল্যায়ন জরিপে’ অংশ নেয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৬১ শতাংশ মনে করেন- দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বছর অর্থ পাচারের হার বাড়ছে, যা ব্যবসায়ীদের জরিপ ফলাফলেও উঠে এসেছে। পাচারের তথ্য এসেছে সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট, পানামা ও প্যারাডাইজ পেপারসে।
জানা গেছে, সমপ্রতি একটি ঘটনা চট্টগ্রাম কাস্টমসে ধরা পড়ে। তাতে দেখা গেছে, ঋণপত্র খোলা হয় কাগজ আমদানির। কিন্তু চীনের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কনটেইনারে পাঠিয়েছে ৪১০ বস্তা বালুমাটি। রহস্যজনক এ ঘটনায় অর্থ পাচার হয়েছে কি-না তা এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ব্যাংকাররা বলেছেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। অথচ রহস্যজনকভাবে বেপরোয়া গতিতে বাড়ছে আমদানি। মূলত এই আমদানির নাম করে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল ও গমেরআমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩৬০ কোটি ৯১ লাখ ডলারের; যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৪৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। সে হিসাবে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ১৪৪.১০ শতাংশ, যা সম্প্রতি সময়ে রেকর্ড হয়েছে। এ সময়ে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে ১৬১.৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ এ পণ্যগুলোর এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

এ ছাড়া এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিও বেড়েছে। গত অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এলসি খোলা বাড়ায় এ খাতে আমদানি খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। গেল অর্থবছরে এ খাতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলের এলসি খোলার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৮৮৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। সেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩৪৯ কোটি ডলার। ফলে গেল অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫.২৩ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৫.৯৪ শতাংশ। অন্যদিকে গেল অর্থবছরের পুরো সময় রপ্তানি বাবদ বাংলাদেশ আয় করেছে ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৬৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। সে হিসাবে গেল অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে মাত্র ৫.৮১ শতাংশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ৬ হাজার ৯৪২ কোটি ২১ লাখ ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ৮১২ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। ফলে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৪.২৫ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ হাজার ১৫৩ কোটি ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ৪২৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার। ফলে এলসি খোলায় নিষ্পত্তি বেড়েছে ১৬.৩৯ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গেল অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয় ৬৪৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৩০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। সে হিসাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ২১.৯৫ শতাংশ। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ৬.২৪ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময়ে পেট্রোলিয়াম তথা জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার ৫২.৮৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৫৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ সময়ে পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি ৩২.৭০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৩৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৫২ কোটি ২২ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শিল্পের কাঁচামালের আমদানি ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে যথাক্রমে ১১.৮৪ শতাংশ এবং ১২.৩৬ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৯৮২ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৭৭২ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। আর এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৮২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার; যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৬২২ কোটি ডলার। এ ছাড়া এ সময়ে অন্যান্য পণ্য আমদানির এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে যথাক্রমে ৬৯.১০ শতাংশ ও ১১.৬২ শতাংশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সামপ্রতিক সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এখানে টাকা পাচারের যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। তার মতে, নির্বাচনী বছরে অনেকে দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করেন না। এ কারণে আমদানিসহ অন্যান্য মাধ্যমে পুঁজি পাচার করা হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পাচার রোধে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। কিন্তু সমপ্রতি আমদানি যে পরিমাণে বেড়েছে, অর্থনীতিতে তার কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কর্মসংস্থান ও পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। রপ্তানিতেও তার প্রভাব সেভাবে পড়েনি। এজন্যই আমদানির চিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=143237