২ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৫৬

সময়মতো পুলিশ না আসায় ভয়াবহ তাণ্ডব আনসার নিহত

শ্রমিক নামধারী সন্ত্রাসীদের হামলায় যমুনা কমপ্লেক্সসহ ১০-১২টি কারখানার ব্যাপক ক্ষতি * পূর্বপরিকল্পিত নাশকতার আশঙ্কা, সুষ্ঠু তদন্তসহ জড়িতদের দ্রুত শাস্তির দাবি


গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন কাশিমপুর ও কোনাবাড়ি শিল্প এলাকায় শ্রমিক হত্যার গুজবে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে শ্রমিক নামধারী একশ্রেণীর সন্ত্রাসী। বৃহস্পতিবার সকালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার শুরুতেই বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে অবহিত করা হলেও কার্যত কোনো ফল হয়নি।

পুলিশের পক্ষ থেকে হামলার শিকার শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে বলা হয়, সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। কোনো সমস্যা হবে না। অথচ পাশাপাশি দুটি পুলিশ থানা সত্ত্বেও পুলিশ যথাসময়ে ঘটনাস্থলে যায়নি। এর ফলে কোনাবাড়িতে অবস্থিত যমুনা কমপ্লেক্সসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানায় ভাংচুর ও হামলার ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সন্ত্রাসীদের হামলায় ভৈরব চন্দ্র সরকার (৩৮) নামে একজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এছাড়া বড় ক্ষতির মধ্যে রফতানিমুখী এসব প্রতিষ্ঠানে বৃহস্পতিবার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় নির্ধারিত পণ্য শিপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঘটনার সূত্রপাত কাশিমপুর এলাকায় হলেও পুলিশের অবহেলার কারণে তা পার্শ্ববর্তী কোনাবাড়ি শিল্প এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াইএম বেলালুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যারা হত্যাকাণ্ডের গুজব ছড়িয়ে হামলা করেছে তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। এর নেপথ্যে কারণ খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি কারা কারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তারপরও হামলাকারীচক্র সুযোগ নিয়ে বিশৃঙ্খলা করে। এ ঘটনার নেপথ্যে যারা আছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, পুলিশ খবর পাওয়ার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে গেছে। তবে যাওয়ার আগেই কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা অনাকাক্সিক্ষত। তবে বিষয়টি তারা সিরিয়াসলি নিয়েছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, কাপড় চুরির ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের মারধরে পোশাক শ্রমিক নিহতের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বাস্তবে ওই শ্রমিক মারা যায়নি। তাকে পরে হাজির করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মকবুল হোসেন জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর থানাধীন হাতিমারা এলাকায় বুধবার মিতালী ফ্যাশন লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় এক শ্রমিককে চুরির দায়ে মারধর করে হত্যার পর গুম করা হয়েছে এমন গুজব ওঠে। এ ঘটনায় ওই কারখানায় শ্রমিকরা বুধবার বিকালে বিক্ষোভ করে। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ আন্দোলনরত শ্রমিকদের আশ্বস্ত করে জানায়, ওই শ্রমিক মারা যায়নি।
তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন এবং বৃহস্পতিবার সকালে তাকে কারখানায় হাজির করা হবে। এরপর শ্রমিকরা সেদিন চলে যায়। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ওই শ্রমিককে হাজির করতে না পারার অজুহাত তুলে ১১টার দিকে কারখানার শত শত শ্রমিক ওই কারখানাসহ আশপাশের ১০-১২টি কারখানায় একযোগে ভাংচুর চালায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এ সময় সেখানে কোনো পুলিশ ছিল না। এ অবস্থায় কাশিমপুর ও কোনাবাড়ি এলাকার স্ট্যান্ডার্ড, এনটিকেসি, মনটেক্স, মাল্টি ফেব্রিক্স, ডেলটা স্পিনিং মিল, যমুনা গার্মেন্টস, তুসুকা ও কেয়া স্পিনিংসহ ১০-১২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্নে ভাংচুর চালায় সন্ত্রাসীরা। যারা বাধা দিতে আসে তাদের ওপরও চড়াও হয়। সন্ত্রাসীদের হামলায় মাথায় গুরুতর আহত হন ডেল্টা স্পিনিং মিলের কর্তব্যরত আনসার সদস্য ভৈরব চন্দ্র সরকার। জানা যায়, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানার প্রধান ফটকের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালালে কর্তব্যরত আনসার ভৈরব চন্দ্র সরকারসহ নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের বাধা দেয়।

এ সময় বহিরাগত শ্রমিকরা লাঠিসোটা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। এতে ভৈরব চন্দ্রসহ কয়েকজন আহত হন। মাথায় লাঠির আঘাতে গুরুতর অবস্থায় ভৈরব চন্দ্রকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ভৈরব চন্দ্র সরকারের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা সদরের গোসাইল বাড়ি। তার পিতার নাম তপন চন্দ্র সরকার। জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট একেএম জিয়াউল আলম যুগান্তরের কাছে ডেল্টা স্পিনিং মিলে দায়িত্বপালনকালে আনসার সদস্য নিহত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেন। যদিও বিষয়টি নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ মুখ খুলতে চাননি।
ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা মালিক কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, তারা খবর দিলেও পুলিশ যথাসময়ে আসেনি। এটি পরিকল্পিত হামলা কিনা সেটি ভাববারও যথেষ্ট কারণ আছে। সরকারের শেষ সময়ে গার্মেন্টসসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানে নাশকতার অংশ হিসেবেও এমন ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে এ দায় পুলিশ প্রশাসন কোনোভাবে এড়াতে পারে না।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এরপর শ্রমিক নামধারী সন্ত্রাসীরা পার্শ^বর্তী কোনাবাড়ি শিল্প এলাকায় গিয়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সব কারখানা ছুটি দেয়া হয়।

যমুনা গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কয়েকশ’ বিক্ষুব্ধ শ্রমিক কারখানার গেটে গিয়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে নিরাপত্তা কর্মীরা গেটটি খুলে দিতে বাধ্য হয়। এরপর শ্রমিক নামধারী সন্ত্রাসীরা যমুনা কমপ্লেক্স চত্বরে ঢুকে সিসি ক্যামেরা, কারখানার জানালার ৪৮টি থাই গ্লাস ও নিরাপত্তা কর্মীদের অফিস ভাংচুর করে। এ সময় তারা অফিসের কাগজপত্র তছনছ করে। এ ঘটনায় তাদের বেশ কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হন।
কোনাবড়ির যমুনা কমপ্লেক্সে কর্মরত প্রধান প্রকৌশলী মো. এরশাদ হোসেন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বহিরাগতদের হামলার আশঙ্কায় পুলিশকে অবহিত করেও কোনো লাভ হয়নি। তারা সঠিক সময়ে ঘটনাস্থলে না পৌঁছায় ব্যাপক ভাংচুরের শিকার হয় দেশের স্বনামধন্য বৃহৎ শিল্প গ্রুপের যমুনা কমপ্লেক্স। এখানে যমুনা ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলসসহ রফতানিমুখী বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক শিল্প কারখানা রয়েছে। তিনি জানান, ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার কারণে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দিতে হয়। এতে করে আমাদের মতো আক্রান্ত শিল্প কারখানার পণ্য শিপমেন্ট নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের কোনাবাড়ী থানার ওসি মো. এমদাদুল হক জানান, কাশিমপুরের হাতিমারা এলাকায় অবস্থিত মিতালী ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা তাদের কারখানার এক শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করেছে এমন গুজব ছড়ায়। পরে তারা বিভিন্ন কারখানায় ভাংচুর করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দুপুর ১টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/107256