২ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৫২

ব্যাংকের আয় কমছে অস্থিরতা বাড়ছে

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে বাড়ছে প্রভিশন সংরক্ষণ; নীরবে শ্রমিক ছাঁটাই

ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে অস্থিরতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে এক বছরে মুনাফার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা আগের বছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। প্রকৃত আয় কমলেও পরিচালন ব্যয় কমেনি, বরং বেড়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে বড় বড় গ্রুপ ঋণ পরিশোধ করছে না। আর মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এর ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে বেশি হারে। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাতের অর্থ দিয়ে। সবমিলে ব্যাংকিং খাতে নিট আয় কমে যাচ্ছে। এ কারণেই ব্যয় সাশ্রয়ের নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করছে কোনো কোনো ব্যাংক। আবার প্রতি মাসে যে পরিমাণ শ্রমিক চাকরি থেকে স্বাভাবিক অবসরে যাচ্ছেন তার বিপরীতে কোনো নতুন লোকবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। ফলে তিনজনের কাজ একজনকে দিয়ে করানো হচ্ছে। এতে ব্যাংকারদের পারিবারিক জীবনে অশান্তি নেমে আসছে। সবমিলে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, ব্যাংকের সর্বোচ্চ আয় হয় বিনিয়োগ থেকে। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মেয়াদে বিনিয়োগ করে। এ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য মুনাফা আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, তার মুনাফা কাক্সিত হারে আদায় হচ্ছে না। এতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ খেলাপি ঋণও এখন আর আদায় হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার মাত্র ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে আয়ের বড় একটি অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, দেশে চলমান পরিস্থিতিতে অন্যান্য খাতের মতো ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। নতুন বিনিয়োগ আসছে না। যে কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমিয়ে দিয়েছে। ফলে আমানতের ওপরও প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুন শেষে অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার ২১০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকেরই প্রায় অর্ধেক। কিন্তু আদায় হয়েছে সবচেয়ে কম। যেমন ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জুন শেষে অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ৬১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে মাত্র ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে ৩৫১ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। আদায়ের হার মাত্র ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ১২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ২০০ কোটি টাকা। গত জুন প্রান্তিকে আদায়ের হার মাত্র ১ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ২ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের ১০ হাজার ২৩৫ কোটি টাকার মধ্যে আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৯১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ২১৫ কোটি টাকা। গত জুন প্রান্তিকে আদায়ের হার মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে সবচেয়ে কম আদায় হয়েছে বেসিক ব্যাংকের। ৯ হাজার ১৮ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় করতে পেরেছে ৩০ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আদায়ের হার আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ। আর রূপালী ব্যাংকের পাঁচ হাজার ২০৯ কোটি টাকার মধ্যে আদায় করতে পেরেছে ৪৯ কোটি টাকা। আদায়ের হার মাত্র শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ।

এ দিকে, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৫৫ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার মধ্যে আদায় করেছে দুই হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, আদায়ের হার মাত্র ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে প্রভিশন ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। মন্দ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া যায় না। এর ফলে ব্যাংকের সামগ্রিক আয় কমে যাচ্ছে। একই সাথে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। একই সাথে ঋণ আটকে যাওয়ায় এর বিপরীতে সংগৃহীত আমানত নির্ধারিত মেয়াদ শেষে নতুন আমানত নিয়ে পুরনো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যার সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

এমনি পরিস্থিতে ব্যাংকের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যাংকগুলো লোকসান কমাতে ব্যয় সাশ্রয়ের নীতি অবলম্বন করেছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো হচ্ছে। ন্যূনতম লোকবল দিয়ে বেশি কাজ করানো হচ্ছে। কেউ কেউ আবার নীরবে শ্রমিক ছাঁটাই করছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার জারির মাধ্যমে লোকবল ছাঁটাই করতে নিষেধ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংকার জানিয়েছেন, আগে যেখানে তার বিভাগে ছয়জন কর্মকর্তা কাজ করতেন, এখন তার বিপরীতে দুইজন লোক দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এতে তাদের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। অনেকেরই পারিবারিক জীবন বলতে কিছু থাকছে না। ছুটির পরেও ব্যাংকে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কুলাতে না পেরে বাসায় ফাইল নিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে তাদের পারিবারিক জীবনে নেমে এসেছে অশান্তি।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিরাজ করলে সামনে ব্যাংকিং খাতের জন্য আরো দুর্দিন আসবে। এতে দেশের অর্থনীতিতে মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/361740