১ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৫

সমাজ ও রাষ্ট্র কেন গঠন করেছে মানুষ?

জনপদে মানুষ বাস করে, আর জনপদের মানুষরাই গঠন করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রেও বাস করে মানুষই। মানুষ মানুষের বন্ধু হবে, সুখ-দুঃখের অংশীদার হবে, মানবিক আচরণ করবে- এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় এই স্বাভাবিক আচরণ রাষ্ট্রসমূহে কতটা হচ্ছে? জাতির নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, রাজনীতির নামে একেক রাষ্ট্রে একেক ছলনায় দুর্বলদের জীবনযাপন অসম্ভব করে তুলেছে ক্ষমতাবানরা। তাই প্রশ্ন জাগে, এমন নিকৃষ্ট ও অমানবিক ব্যবস্থার জন্যই কি মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছে? বর্তমান বাস্তবতায় এসব ব্যবস্থা না থাকলে কি মানব সভ্যতা কিংবা মানব জাতির তেমন কোন ক্ষতি হবে? জানি, এমন প্রশ্নে সৃষ্টি হবে আরো বহু প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নটি সৃষ্টি হওয়ার মতো বাস্তবতা কি নেই? আর অনাকাক্সিক্ষত সেই বাস্তবতা পরিশোধনে কিংবা দূরীকরণে সভ্যতার শাসকরা, রাষ্ট্র পরিচালকরা ন্যায়ের চেতনায় যৌক্তিক ভূমিকা পালন করছেন না কেন? শাসকদের হৃদয়টা কি পুরোপুরি কালো হয়ে গেছে?

বিভিন্ন রাষ্ট্রে শাসকদের, ক্ষমতাসীনদের মনোজগতের ভাবনা চেতনায় রূপ নিয়ে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চেতনা মানুষের জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে। বর্তমান সময়ে অশুভ চেতনার দৌরাত্ম্যই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিনই আমাদের দৃষ্টির সীমানায় ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। ২৭ অক্টোবর এনডিটিভির খবরে বলা হয়, ভারতের রাজধানী দিল্লীতে আসিম নামে ৮ বছরের এক মাদরাসা ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় যুবকরা। দক্ষিণ দিল্লীর মালভিয়া নগর এলাকার দারুল উলূম ফরিদিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে এনডিটিভি জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার মাদরাসার কয়েকজন শিশু-কিশোর মিলে মাঠে খেলা করছিল। তখন স্থানীয় কয়েকজন যুবক এসে তাদের ওপর হামলা করে। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, হামলার শিকার ছাত্ররা মাদরাসার ভেতরে দৌড়ে চলে যায়। তবে ৮ বছরের আসিম হামলাকারীদের হাতে আটকা পড়ে যায়। ওদের নির্মম হামলায় শিশুটি নিহত হয়।

মাদাসার শিক্ষক আলী জোহর জানান, আসিম হিফজ বিভাগে পড়তো এবং সে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। তাদের মাদরাসা ও মসজিদ মিলে যে জায়গাটি রয়েছে সেটি স্থানীয় কিছু লোক দখলের জন্য বহু দিন ধরে পাঁয়তারা করে আসছে। মাঝে মাঝে কিছু লোক মাদরাসা প্রাঙ্গণে এসে জুয়া খেলে। কখনো মদের বোতল ছুঁড়ে মারে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এমন চিত্রে উপলব্ধি করা যায় কারা কেন মাদরাসা ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আর হামলা তো ক্ষমতাবানরাই চালায়। তাদের কারা কেন ইন্ধন দেয় তাও তেমন অস্পষ্ট কোন বিষয় নয়। তাই আবারও সেই প্রশ্নটি করতে হয়, এভাবে নিহত হওয়ার জন্যই কি মানুষ সমাজবদ্ধ হয়, রাষ্ট্র গঠন করে। উক্ত ঘটনায় দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল সমবেদনা জানিয়েছেন এবং ৫ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী তো প্রথাগতভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু অর্থ দিয়ে কি জীবনের ক্ষতিপূরণ করা যায়, অসভ্য ও অমানবিক চেতনার সংস্কার করা যায়? মানুষ তার এই দৈন্য ঘুচাবে কেমন করে? দৈন্য তো শুধু ভূগোলের এক জায়গায় নয়, পুরো পৃথিবীটাই যেন এখন দৈন্যের পৃথিবী।
‘শিক্ষাকেন্দ্রের নামে অন্তরীণ উইঘুর মুসলিমরা’- এটি একটি খবরের শিরোনাম। ২৫ অক্টোবর এএফপি প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশের হোতানে এক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একদল শিক্ষার্থী আনন্দের সাথে চাকরির দক্ষতা বাড়াতে মান্দারিয়ান ভাষা শিখছে। শুধু তাই নয়, তারা বিভিন্ন শখ পূরণের অংশ হিসেবে খেলাধূলা ও ঐতিহ্যগত নাচেরও চর্চা করছে। অথচ আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এখানে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো কিছুই ঘটছে না। চলতি বছরের শুরুর দিকে দেখা গেছে, স্থানীয় সরকারের যে বিভাগটি শিনজিয়াং প্রদেশের হোতাল নামের ওই জায়গার দায়িত্বে রয়েছে, তারা শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত তেমন কোনো কিছুই কিনেন নি। বরং তারা এমন সব যন্ত্রপাতি কিনেছেন যেগুলো দমন-পীড়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের কেনা উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৭৬৮টি পুলিশের লাঠি, ৫৫০টি ইলেকট্রিক লাঠি, ১ হাজার ৩৬৭টি হাতকড়া, ২ হাজার ৭৯২টি পেপার স্প্রের ক্যান।
এমন বাস্তবতায় মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, চীন এখানে কোনো শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেনি। বরং পুনঃশিক্ষার নামে প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে এখানে জোর করে আটকে রেখেছে। তবে চীন শুরু থেকে বিষয়টি অস্বীকার করে এলেও জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আটকে রাখার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তবে তারা উইঘুর মুসলমানদের ওপর দমন-পীড়নের কথা অস্বীকার করেছে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে, ওইসব কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষা ও চাকরির প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদ, সহিংসতা ও ধর্মীয় চরমপন্থা অবলম্বনের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সরকারের এমন প্রপাগা-া বাস্তবচিত্রের সাথে মিলছে না। টেন্ডার ও বাজেট সম্পর্কিত চীন সরকারের দেড় হাজারের বেশি অফিসিয়াল নথির হদিস পেয়েছে এএফপি। যেগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, আসলে সেটা স্কুল নয় বরং জেলখানা। চীন সরকারের কথিত ওই শিক্ষাকেন্দ্রের চারপাশে হাজার হাজার প্রহরী টিয়ারগ্যাস, টেসার, স্টেনগান, তীক্ষè লাঠি নিয়ে তাদের ‘শিক্ষার্থীদের’ পাহারা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, নথি অনুযায়ী কেন্দ্রটি রেজর তার ও ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে। এএফপির পাওয়া এক নথিতে শিনজিয়াং প্রদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি চেন কুয়ানগুয়ে বলেছেন, এ কেন্দ্রে স্কুলের মত শিক্ষা দেয়া উচিত। এছাড়া সেনানিবাসের মত ব্যবস্থাপনা ও জেলাখানার মত রক্ষা করা দরকার। এসব তথ্যের আলোকে উপলব্ধি করা যায়, শিক্ষাকেন্দ্রের নামে সেখানে প্রায় ১০ লাখ উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিমকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন এই অন্তরীণ? এভাবে আটকে রেখে দমন-পীড়ন ও অবদমন তো স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লংঘন। বিষয়টিকে জাতিগত নিপীড়ন হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের যৌক্তিক ভূমিকা আমাদের কাম্য। চীনের কাছ থেকেও আমরা আশা করি ন্যায় ও মানবিক আচরণ।

http://www.dailysangram.com/post/351665