৩০ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৪৫

এননটেক্সের ঋণ অনিয়মে জনতার পর্ষদও দায়ী

জনতা ব্যাংকে এননটেক্স গ্রুপের ঋণ অনিয়মের পেছনে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদও দায়ী। এলসির বিপরীতে পণ্য আসার পর ব্যাংকের টাকা আদায় না করে 'ফোর্স ঋণ' সৃষ্টি করা হয়েছে। ঋণ আদায়ের উদ্যোগ না নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ এসব ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে মেয়াদিতে পরিণত করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সুকৌশলে পর্ষদের গোচরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এননটেক্সের সব ঋণই মঞ্জুর করেছে পরিচালনা পর্ষদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের নির্দেশনার আলোকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিশদ পরিদর্শনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক বর্তমান ডিজিএম মিজানুর রহমান আকনের নেতৃত্বে পরিদর্শনটি পরিচালিত হয়। পরিদর্শনে উঠে আসা অনিয়মের ভিত্তিতে এননটেক্স গ্রুপকে নতুন ঋণ বন্ধসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এমওইউ অনুযায়ী জনতা ব্যাংক তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ফান্ডেড ঋণ দিতে পারে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ২৩৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৪২৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সুযোগ ছিল। অথচ মোহাম্মদ ইউনুছ বাদলের মালিকানাধীন এননটেক্স গ্রুপকে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ফান্ডেড ছিল চার হাজার ৮০৫ কোটি টাকা।
এসব ঋণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সুকৌশলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা, পূর্ববর্তী উৎপাদন ও বিক্রয় দক্ষতা বিবেচনা না করে শুধু প্রাক্কলিত আর্থিক বিবরণী ও কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে নতুন নতুন প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলের পরও গ্রাহক নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। অথচ এমওইউর নির্দেশনা লঙ্ঘন করে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর পুনরায় ১৫০ কোটি টাকার ঋণসীমা অনুমোদন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালন না করার জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদ দায়ী।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনে এননটেক্সের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানির জন্য বিভিন্ন সময়ে এলসি খোলা হয়। এসব এলসির বিপরীতে সৃষ্ট দেনা গ্রাহকের পরিশোধ করার কথা। তবে ব্যাংক টাকা আদায় না করে গ্রাহকের নামে 'ফোর্স লোন' সৃষ্টি করেছে। এমনকি মঞ্জুরিপত্রের শর্তের আলোকে গ্রাহকের কাছ থেকে এলসি মার্জিনও নেওয়া হয়নি। কাঁচামাল থেকে পণ্য প্রস্তুতের পরও দেনা আদায়ে ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংক। এভাবে সৃষ্ট অনেক ফোর্স লোন খেলাপি হলেও তা আমলে না নিয়ে নতুন করে এলসি খোলা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে এ প্রবণতা দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে এসব ঋণ আদায়ের উদ্যোগ না দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ থেকে বারবার পুনঃতফসিল করে ফোর্স ঋণকে মেয়াদি ঋণে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমানে শুধু ফোর্স লোনের বিপরীতে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। এসব ঋণের অধিকাংশই বিরূপ মানের খেলাপি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে দুই মেয়াদে পাঁচ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় এননটেক্স গ্রুপের ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। আবুল বারকাতের পর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান। জনতা ভবন করপোরেট শাখার প্রস্তাবের বিপরীতে এসব ঋণ অনুমোদন করা হয়। ঋণপ্রস্তাব পাঠানোর সময়ে শাখাটির ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন জনতা ব্যাংকের বর্তমান এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ। এ বিষয়ে আবদুছ ছালাম আজাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত সমকালকে বলেন, পরিচালনা পর্ষদে সরাসরি কোনো ঋণপ্রস্তাব আসে না। ক্রেডিট কমিটি এবং ম্যানেজমেন্ট কমিটির সুপারিশের পর তা পর্ষদে উত্থাপন হয়। এ দুই স্তরের সুপারিশ ছাড়া তার সময়ে কোনো প্রস্তাবনা পর্ষদে উত্থাপন হয়নি। আবার পর্ষদ থেকে অনুমোদনের পর ঋণছাড়ের পুরো বিষয়টি দেখভাল করে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। আর ২২টি প্রতিষ্ঠান যে ইউনুছ বাদলের মালিকানাধীন এননটেক্স গ্রুপের; তা তারা জানতেন না। তারা জানতেন, পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বাদল। তার সময়ে পরিচালনা পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংকের আজকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ অনেকেই ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমার দ্বারা কোনো খারাপ কাজ হয়নি। আমার সময়ে কোনো খারাপ কাজ যদি হয়ে থাকে, তাহলে তথ্যের ভুলের কারণে হয়েছে। অথবা আমাকে বোকা বানানো হয়ে থাকতে পারে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাতুরী বিন্যাসের মাধ্যমে প্রকল্প মূল্যায়ন, এক প্রকল্প থেকে তহবিল অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর, প্রকল্পগুলো একই গ্রুপভুক্ত এবং মূল কর্ণধার একজন হলেও নতুন নতুন কোম্পানি সৃষ্টির মাধ্যমে অনেক বেশি ঋণ পুঞ্জীভূত করা হয়েছে। ব্যাংক প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি তদারকি না করায় এবং কিছু প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিনেও শেষ না হওয়ায় তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইউনুছ বাদলের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে গ্যালাক্সি সোয়েটার্স অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং, সুপ্রভ কম্পোজিট নিট, সিমরান কম্পোজিট এবং লামিসা স্পিনিংয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংক পাবে দুই হাজার ২৮১ কোটি টাকা। বাকি সব প্রতিষ্ঠান বাদলের বাবা, স্ত্রী, ভাই, ভাবিসহ পরিবারের অন্যদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। যদিও সব প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী ইউনুছ বাদল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এননটেক্সের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ২২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮টি গাজীপুরের টঙ্গীর ভাদাম এলাকায় একই কম্পাউন্ডে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংক পাবে চার হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। একই কম্পাউন্ডে অবস্থিত হলেও প্রকল্পের ভূমি ও যন্ত্রপাতি ব্যাংকের কাছে আলাদাভাবে দেখানো হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও আলাদাভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে পরিদর্শক দলের পরামর্শে সম্প্রতি ব্যাংক এসব সম্পত্তি 'জনতা ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ' মর্মে সাইনবোর্ড দিয়েছে। বাকি চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে এম নূর সোয়েটার্স, ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে এমএইচ গোল্ডেন জুট মিলস, নরসিংদীর শিবপুরে সবমেহের স্পিনিং মিলস ও সাইনিং নিট অবস্থিত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল বলেছে, সার্বিক তথ্য বিশ্নেষণে এসব ঋণের অধিকাংশই গুণগত মানে শ্রেণিকরণযোগ্য। তবে একবারে বিপুল অঙ্কের ঋণখেলাপি করলে ব্যাংকের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। যে কারণে আপাত বস্তুগত মাপকাঠিতে দুই হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার ঋণখেলাপি করতে হবে। আর বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং পর্ষদে যাদের অনুমোদন ও তদারকির দুর্বলতার কারণে ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে, মূলত দায়-দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়।

জনতা ব্যাংকের সংশ্নিষ্টরা জানান, একক প্রতিষ্ঠানে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ঘটনায় জনতা ব্যাংক বিব্রত। তবে এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একেবারে দায় এড়াতে পারে না। এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক বর্তমানে ডিজিএম মোহাম্মদ জহির হোসেনের নেতৃত্বে একটি পরিদর্শন পরিচালিত হয়। তখন এননটেক্স গ্রুপের ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি একই কম্পাউন্ডে থাকলেও একই গ্রুপভুক্ত বলা হয়নি। ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র এক হাজার ৮২০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ফোর্স লোন ছিল মাত্র ২০২ কোটি টাকা। ওই সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে একক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে নতুন করে ঋণ বিতরণ থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হলে হয়তো আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে আসা অনিয়মের আলোকে বিভিন্ন ব্যবস্থা চলমান।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এননটেক্সের ২২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রকল্প ঋণ রয়েছে ১৭টির নামে। অথচ ব্যাংকের ইস্যু করা প্রকল্প সম্পন্নকরণ রিপোর্ট (পিসিআর) অনুযায়ী কাজ শেষ হয়েছে মাত্র সাতটির। বাকি ১০টির মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ একটি আটতলা ভবনে স্থাপন করা হয়েছে। এসব ঋণ দেওয়ার আগে গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা যাচাই করে ঝুঁকি হিসাবায়ন না করায় ব্যবসার গতি কোন দিকে কী অবস্থায় আছে, ব্যাংক তা বুঝতে পারছে না। ঋণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রাহকের দক্ষতা বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছে। আবার বিভিন্ন সময়ে যে চলতি মূলধন ঋণ দেওয়া হয়েছে, এর মোট স্থিতি গ্রাহক কর্তৃক সরবরাহ করা মোট স্টক রিপোর্টের চেয়ে অনেক বেশি।

 

http://samakal.com/economics/article/18101868