বড়লেখা উপজেলার চান্দগ্রামে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় মারা যাওয়া কন্যাশিশুটির শোকাহত মা। ছবি: সমকাল
৩০ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৪৪

বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে দেখেও ওরা ছাড়েনি'

পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘটের সময় মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার চান্দগ্রামে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় মারা যাওয়া সাতদিনের কন্যাশিশুর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন না কেউই।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শিশুটির মা সায়রা বেগম বলেন, তারারে কইছি, আমার বাচ্চাটা অসুস্থ। কষ্ট অর। ছাড়ি দেও। আমি দেখিয়ার আমার বাচ্চাটা মারা যায়। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি। তারা উল্টা কইন কিসের রোগী। একেকজন শ্রমিক একেক কথা কয়। ধমক দেয়। ড্রাইবাররে কইছি আমাকে নামাইয়া দেও। আমার শরীর কিতা করের। আমি হাটিয়া যাইমু গিয়া। চোখের সামনে বাচ্চাটা ওখানেই মারা যায়।
বড়লেখা সদর ইউনিয়নের অজমির গ্রামের বাসিন্দা প্রবাসী কুটন মিয়ার সাতদিনের কন্যাশিশুকে রোববার সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে রওনা করা হয়। পথে পরিবহন শ্রমিকরা চান্দগ্রামে প্রায় দেড় ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রাখে। এতে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই শিশুটি মারা যায়।

সোমবার দুপুরে শিশুটির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, শোকাহাত পরিবারটিতে শান্ত্বনা দিতে বাড়িতে ভিড় করছেন স্বজন, এলাকার লোকজন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এমন ঘটনায় ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছেন তারা। একই সঙ্গে তারা এ ঘটনায় জড়িত শ্রমিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
শিশুটির বাবা কুটন মিয়া বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়ার পথে পুরাতন বড়লেখা বাজারে ড্রাইভারের কাগজপত্র, আমার বাচ্চার কাগজপত্র চেক করছে। এতো রিকোয়েস্ট করছি। ছাড়ছিল না। আধা ঘণ্টা পরে ছাড়ছে। ইকান থাকি দাসের বাজার গিয়ে আটকা পড়ি। তারা গাড়ি ব্যারিকেড দেয়। ওইখানেও কাগজপত্র দেখে ছাড়েনি। অনেক উত্তেজনা করেছে। গাড়ি থেকে ড্রাইভার টানিয়া নামাইছে। মারধর করেছে। অনেক অনুরোধ করেছি। ছাড়েনি। তাদের ইচ্ছামতো পরে ছাড়ছে। চান্দগ্রাম যাওয়ার পরে আবার আটকাইছে। অনেক অনুরোধ করলাম। সেইখানেও ছাড়েনি। দেড় ঘণ্টার মতো রাখছে। খুব অনুরোধ করার পর ৫০০ টাকা দাবি করছে। তখন আমি আমার পকেট থেকে ৫০০ টাকা বের করি। তারা বলে, তুমি দিলে হবে না। ড্রাইভারের দিতে হবে। এরই মাঝে আমার মেয়েটা মারা যায়। এরপর যখন তারা গাড়িতে এসে দেখে বাচ্চা মারা গেছে, তখন তারা গাড়িসহ বাচ্চা ছাড়ে। আমি এই ঘটনার বিচার চাই।

অ্যাম্বুলেন্স চালক শিপন আহমদ বলেন, আমি হাসপাতাল থেকে টিপ (ট্রিপ) নিয়ে পুরাতন বড়লেখা যাই। পুরাতন বড়লেখা বাজারে ৫ থেকে ৬ জন আটকায়। তারা যাইতে দেয় না। তারা বলে, বিয়ার অনুষ্ঠানে যাইরায়। এর লাগি নাটক সাজাইয়া যাইরায়। কাগজপত্র দেখাইছি। তারপর ছাড়ছে। এরপর দাসেরবাজার আটকাইছে। দাসেরবাজারে খুব বেশি ডিস্টার্ব দিছে। আধাঘণ্টার মতো। আমার কলার ধরে টানাটানি করেছে। কাগজপত্র দেখতে চাইছে। কাগজপত্র দেখাইছি। বাচ্চার ছাড়াপত্রও দেখাইছি। তাও ছাড়ে না। পরে জোরেজারে ছুটছি। পরে চান্দগ্রাম গেলে সেখানেও আটকায়। সেখানে বাচ্চার বাবার কাছে একজন ৫০০ টাকা দাবি করে। বলেছে, ৫০০ টাকা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাও। তারা চাঁদা দাবি করেছে। তাদের দেখলে চিনব। এদের মাঝে কিছু সিএনজি ড্রাইভারও আছেন।
শিশুটির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না গ্রামবাসী। গ্রামের বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। এদের কি কোনো বিবেক নেই? একটা বাচ্চা মারা যাচ্ছে। গাড়িটি ছাড়েনি। উল্টো উপহাস করেছে ওর মা-বাবাকে নিয়ে। এটা কোন ধরনের আন্দোলন! এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

আর বড়লেখা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদ বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের নামে একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। শিশুটির পরিবার আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা। ঘটনার পর থেকে তাদের সার্বিক খোঁজখবর নিচ্ছি। শ্রমিক ধর্মঘটের নামে এই অযৌক্তিক আন্দোলন দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানাই। পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই।
বড়লেখা থানার ওসি মো. ইয়াছিন আলী বলেন, আমরা শিশুটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। বাড়িতে গিয়েছি। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

http://samakal.com/whole-country/article/18101853