৩০ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩৯

ধর্মঘটের শহরে পাঁচ ঘণ্টা

সকাল সাড়ে ১০টা। রাজধানীর উত্তর বাড্ডা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছু মানুষ। কেউ অফিসে যাবেন, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কেউবা কোনো ব্যক্তিগত কাজে। কিন্তু সবার চোখেমুখে হতাশার ছাপ। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই। যাবেন কীভাবে তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। গুটি কয়েক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চললেও আগে থেকেই যাত্রী নিয়ে আসছে।

এই স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো যাত্রী নিজ গন্তব্যে যেতে পারছিলেন না। আধাঘণ্টা পর একটি বিআরটিসি বাস এলেও তাতে অনেক যুদ্ধের পর উঠতে পেরেছেন মাত্র তিন-চারজন।
বাকিরা দাঁড়িয়েই ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন অসুস্থ। হোসনে আরা নামের ওই অসুস্থ নারী যাবেন বারডেম হাসপাতাল। একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা সামনে এলেও তাতে উঠতে পারেননি। তার ছেলে খুব চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সিএনজিচালক চাইলেন সাড়ে চারশ’ টাকা। বাড্ডা থেকে শাহবাগ বারডেম হাসপাতাল পর্যন্ত এত ভাড়া দিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভবও নয়।

উত্তর বাড্ডা বাস স্টপেজ থেকে কিছুদূর সামনেই অবস্থিত বাড্ডা জেনারেল হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন শামীম নামের একজন। কাজ শেষে বাড়ি ফিরবেন। যাবেন টঙ্গী নিজ বাড়িতে। কিন্তু কিছু না পেয়ে সকাল থেকে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও যেতে পারলেন না শামীম। তিনি বলেন, ডাক্তারের কাছে এসে এখন আর যেতে পারছি না। ভোর বেলায় সিএনজি একটা পেয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পেরেছি। কিন্তু এখন আটকে গেলাম।

দুপুর ১২টা। বাড্ডা লিংক রোডে গিয়ে দেখা যায় শত শত মানুষ। অপেক্ষা করছেন কোনো একটি বাহনের। অফিস কিংবা ব্যক্তিগত কাজে যাওয়াই সবার উদ্দেশ্য। কিন্তু কোনো যানবাহন না পেয়ে খুব হতাশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সবাই। এই লিংক রোড থেকে মহাখালী, ফার্মগেট, মিরপুর, গাবতলীমুখী যাত্রীর সংখ্যা বেশি। রিকশাগুলো গুলশানের পর আর যাবে না। তাই রিকশাতে উঠতেও চাইছেন না অনেকে। এ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় তাদের। এদিকে লিংক রোড থেকে কুড়িল বিশ্বরোডগামী অনেক যাত্রী দাঁড়িয়েছিলেন ওই স্টপেজে। যানবাহন নেই। যাবেন কি করে! প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর একটি ভ্যানগাড়ি সামনে আসে। ভ্যানচালক বললেন, কুড়িল পর্যন্ত প্রতিজন ৫০ টাকা। তা শুনেই ঝটপট ৭-৮ জন উঠে পড়লেন ভ্যানে।

দুপুর ১টা। মহাখালী তিতুমীর কলেজের সামনে দেখা গেল কলেজ ফটকের বিপরীত পাশে অবস্থিত ব্যাংক এশিয়ার সামনে ১২-১৫ জনের মতো শিক্ষার্থী বসে আছেন। জানা গেল সাড়ে এগারোটার দিকে ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও যানবাহন না থাকায় বাড়ি ফিরতে পারছেন না তারা। আমতলী বাসস্ট্যান্ডেও একই চিত্র। এখানে নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায় অনেককে। তাদের মধ্যে দুজন ক্লান্ত হয়ে বসেই ছিলেন ফুটপাথের ওপর। তবে এখানে এসে কয়েকজন মোটরসাইকেল চালক যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করছেন কোথায় যাবেন? যাত্রীদের সঙ্গে মোটরসাইকেল চালকের গন্তব্যে মিল থাকলেও মেলেনি ভাড়ায়। চালক মহাখালী থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ভাড়া চাইলেন ২০০ টাকা।

এ নিয়ে কয়েকবার তর্কবিতর্কের পর মোটরসাইকেল চালক চলে গেলেন। আমতলী থেকে কিছু দূরেই অবস্থিত মহাখালী বাস টার্মিনাল। সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে। ধর্মঘট চলায় কোনো বাসই ছেড়ে যাচ্ছে না। তবে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কয়েকজন বাসচালক। এনা পরিবহনের একটি বাসের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডায় মেতেছিলেন তারা। টার্মিনালের ভেতরে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক ঘুমাচ্ছেন। পাশেই আরেকটি বাসের ভেতর দেখা যায় কয়েকজন মিলে তাস খেলছেন।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে জাহাঙ্গীর গেট হয়ে আগারগাঁও গিয়ে দেখা যায় সেখানেও অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন নিজ নিজ গন্তব্যের জন্য। সেখান থেকে শ্যামলী যাওয়ার জন্য এক ব্যক্তি রিকশা খুঁজছেন। একজনকে পেয়েছিলেনও তিনি। কিন্তু ভাড়ায় মিলছে না। রিকশাচালক শ্যামলী পর্যন্ত ৮০ টাকা দাবি করে বসলেন। পঞ্চাশ টাকা বলার পরও রাজি নন চালক। শেষতক সত্তর টাকা ভাড়ায় যেতে রাজি হয়েছেন। এ ঘটনা দুপুর আড়াইটার। বিকাল তিনটা। গণপরিবহন শূন্য রাজধানী থেকে বাইরে যাওয়ার অন্যতম স্থান গাবতলী। দুই একটি বিআরটিসি বাস ছাড়া আর কিছুই চলছে না সেখানে। যানবাহন না পেয়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যেতে দেখা গেছে অনেককে। কল্যাণপুর থেকে নুপুর নামের এক শিক্ষার্থী পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। যাবেন আমিন বাজার। এর মধ্যে গাবতলী আসার পর ছিঁড়ে গেছে তার পায়ের জুতা। এ সময় নুপুরকে ছেঁড়া জুতা হাতে নিয়ে হাঁটতে দেখা যায়। তিনি বলেন, একটা আজব দেশে বাস করি।

পায়ের জুতাটাও ছিঁড়ে গেছে হাঁটতে হাঁটতে। বাস তো বন্ধ। একটা সিএনজিও যেতে রাজি হচ্ছে না। কল্যাণপুর থেকে হেঁটে আসছি। আরো হাঁটবো। আজ হেঁটেই বাসায় যাবো। গাবতলী বাস টার্মিনালে এ সময় কয়েকজন প্রাইভেটকার চালক ডাকছেন সাভার যাত্রী নিয়ে যাবেন বলে। কিন্তু সেখান থেকে ভাড়া হাঁকাচ্ছেন জনপ্রতি ২০০ টাকা। যার যার সামর্থ্যে মিলেছে তারা উঠে গেলেন প্রাইভেটকারে। আর কেউ কেউ অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু এক ঘণ্টা অপেক্ষার পরও কোনো যানবাহন পাননি তারা। এর মধ্যে আবার মোটরসাইকেল চালকও কয়েকজন এসে সাভার যাওয়ার ডাক দিলেন। তাতেও বিপত্তি। গাবতলী থেকে সাভার পর্যন্ত যেতে আড়াইশ টাকা ভাড়া দাবি মোটরসাইকেল চালকদেরও। অন্যদিকে গাবতলী থেকে কল্যাণপুর শ্যামলীগামী কোনো যানবাহন ছিল না এই সময়টিতে। এখান থেকে কারওয়ান বাজারের দিকে যাওয়া যাত্রীরা বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন তখন।

আরিফা নামে এক তরুণী কিডনি হাসপাতালে যাবেন। কিন্তু কোনো যানবাহন পাচ্ছেন না। হতাশ হয়ে সড়কেই দাঁড়িয়েছিলেন মাকে নিয়ে। তিনি বলেন, বিকাল পাঁচটায় ডাক্তার আসবেন। মায়ের কিডনির সমস্যা। তাকে নিয়ে শ্যামলীতে হাসপাতালে যাবে। কিন্তু কিভাবে যাবো তাই ভেবে পাচ্ছি না। এখানে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অসুস্থ মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা খুব অসহায়।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=142716