৩০ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩১

ব্যক্তি খাতের বৈদেশিক ঋণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা

দায়ের বোঝা চাপছে রাষ্ট্রের ওপর

বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশী ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত আগস্ট পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মিলে বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকাই স্বল্পমেয়াদি (এক বছরের কম মেয়াদে) ঋণ।

বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, বেসরকারি পর্যায়ে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এর দায়ের বোঝা চাপচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর। কারণ, এসব ঋণ হলো সরবরাহ ঋণ, যা হার্ড লোন হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ এ ঋণের সুদ নির্ধারণ হয় বাজার রেটে। এ কারণে এসব ঋণের সুদ তুলনামূলকভাবে বেশি। আবার এসব ঋণ নেয়া হয় বিদেশী মুদ্রায়, পরিশোধও করা হয় বিদেশী মুদ্রায়। তাই এসব ঋণ বেশি হলে দেশের ওপর চাপ বাড়ে।
কেন বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, যখন ব্যবসায়ীদের বিদেশী ঋণ আনার অনুমোদন দেয়া হয় তখন দেশীয় ব্যাংকগুলোর তারল্য সঙ্কট চলছিল। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদেরকে ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল না। টাকার সঙ্কটের কারণে ঋণের সুদহারও আকাশমুখী হয়। তখন ব্যাংকগুলোও উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে। তখন আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৪ টাকা। এ সময়কাল ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরের দিকে। উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ হারে ঋণ দিতে থাকে ব্যাংকগুলো। এতে পণ্যের উৎপাদনব্যয়ও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি।
এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়ীদেরকে বৈদেশিক ঋণ আনার অনুমোদন দেয়। সর্বোচ্চ ৫ বছর মেয়াদি এসব ঋণ আনতে সুদ হিসেবে ব্যবসায়ীরা ক্ষেত্রবিশেষ সাড়ে চার থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করে। এর পর অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের তহবিল সঙ্কট মেটায়। এমনকি এক বছরের কম মেয়াদি এসব ঋণ আনতেও ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ সাড়ে চার শতাংশ সুদ দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব ঋণের সুদ আপাতত কম মনে হলেও কার্যকারী হার আরো বেড়ে যাবে। যেমন এক জন বিনিয়োগকারী বিদেশ থেকে ৬ শতাংশ হারে ১০০ কোটি ডলার (৮৪ টাকা প্রতি ডলার হিসেবে) ঋণ গ্রহণ করল। এক বছর পর প্রতি ডলার ৯০ টাকা হলে প্রতি ডলারে টাকার মান কমে প্রায় ৭ শতাংশ। যেহেতু ডলারে ঋণ করে টাকায় ব্যয় করলেও ডলারে পরিশোধ করায় বিনিময় হারের কারণে সুদ ব্যয় বেড়ে হবে (৬+৭) সোয়া ১৩ শতাংশ। এভাবে কেউ ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি বিদেশী ঋণ নিলে কার্যকরী হার অনেক বেড়ে যাবে। যেমন, ২০১৬ সালে প্রতি ডলার ছিল ৭৯ টাকা, বর্তমানে যা আমদানিপর্যায়ে ৮৫ টাকায় উঠে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ২০১১ সালে ৯২ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। তার পরের বছর ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। এর পর থেকে প্রতি বছরই তা বাড়তে থাকে। এর সাথে যোগ হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক ঋণের জোগান দিয়ে আসছে। অর্থাৎ ব্যাংক বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে ওই ঋণ আবার ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিতরণ করছে। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে প্রকল্প ঋণ ও অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত আগস্ট পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন শ’ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে বেসরকারি পর্যায়ে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর হাতে এখন পর্যাপ্ত অলস টাকা রয়েছে। এ সময় ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে এ থেকে যে সুদ পরিশোধ করত তা দেশেই থেকে যেত। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বাড়ত না। এতে ব্যাংকগুলোরও তহবিল ব্যয় কমত যার সামগ্রিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়ত। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণ নেয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় সুদ পরিশোধ করছেন। এসব ঋণের সুদও বৈদেশিক মুদ্রায় চলে যাচ্ছে বিদেশে। এ ব্যয় বেড়ে গেলে তার প্রভাব বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর পড়বে। ইতোমধ্যে রফতানি আয় কমে গিয়ে ও আমদানি ব্যয় তুলনামূলক বেশি বেড়ে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ বাড়তে থাকলে রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও কল্যাণকর হবে না বলে তারা মনে করছেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/360976