৩০ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১৮

পোড়া মবিলে কালিমালিপ্ত প্রিয় স্বদেশ

লিখতে বসে যখন কলম চলে না, তখনও আমাদের লিখতে হয়। লিখতে হয় পাঠকের জন্য, দেশ, মানুষ, সমাজকে লিপিবদ্ধ ফর্মে ধরে রাখার দায়িত্বের কারণে। প্রাত্যহিক এ কর্মটি আমাদের চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আজ যেন কলম চলতেই চাইছে না। রোববার সারা দেশের সড়কে সড়কে যা ঘটেছে, যে পৈশাচিক উল্লাস ও বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে তার সম্পূর্ণ বিবরণ দেয়া দুঃসাধ্য।

মৌলভীবাজারের অজমির গ্রামের যে শিশুটি জন্মছিল মাত্র এক সপ্তাহ আগে। রোববার পর্যন্ত যে শিশুটির নাম পর্যন্ত রাখা হয়নি, সেই শিশুটি অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না, তার আগেই হয়ে গেল সংবাদপত্রের সংবাদ শিরোনাম, পাড়ি জমাল পরপারে- পথে পথে দুর্বৃত্তরা তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে দেয়ায়। বেলা ১১টায় রওনা দিয়ে দুপুর আড়াইটা- সাড়ে তিন ঘণ্টায় মাত্র ২০ কিলোমিটার পথ যেতে পেরেছিল তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি।

হাসপাতাল তখনও ৫০ কিলোমিটার দূরে। কোন সমাজে আমরা বাস করছি? ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?’ এটাই কি আমাদের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ অর্জিত মাতৃভূমি, যা আজ পরিণত হয়েছে মনুষ্যত্বহীন পশু ও কিছু দুর্বৃত্তের অভয়ারণ্যে, যেখানে আজ মানুষ পরিণত হয়েছে তাদের অসহায় শিকারে?
রোববার সারা দেশে পথে পথে যা ঘটেছে তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন অরাজকতার উদাহরণ বললে ভুল বলা হবে না বোধকরি। অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে গত দু’দিন কিছু দুর্বৃত্ত হরণ করেছে মানুষের অধিকার। তারা যে শুধু অ্যাম্বুলেন্স আটকে শিশুর মৃত্যু ঘটিয়েছে তাই নয়, তারা লাঞ্ছিত করেছে তাদেরই সহকর্মী চালকদের।
তারা চালকদের মুখে পোড়া মবিল মেখে দিয়েছে। পোড়া মবিল মেখে দিয়েছে যাত্রী ও শিক্ষার্থীদের গায়ে-পোশাকে। অনেক জায়গায়ই তারা যানবাহন ভাংচুর তো করেছেই- পিটিয়েছে চালক এবং যাত্রীদেরও। এ কেমন আন্দোলন? এ কেমন দাবি আদায়? এমন আন্দোলন কিংবা দাবি আদায়ের কথা কেউ কোনোদিন শোনেনি, কোনোদিন কল্পনাও করেনি।

সব হরতাল-ধর্মঘটেই কিছুসংখ্যক গাড়ি বা বিকল্প যানবাহন চলাচল করে। এই ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে ব্যক্তিমালিকানাধীন যানবাহন থেকে যাত্রীদের শুধু নামানোই হয়নি, চড়-থাপ্পড়, লাঠিপেটায় তাদের লাঞ্ছিতও করা হয়েছে। এর নাম তো আন্দোলন নয়, এটা সুস্পষ্ট অপরাধকর্ম। যারা এ কাজ করেছে তাদের শ্রমিক বলা যায় না, তারা অবশ্যই দুর্বৃত্ত এবং অপরাধী। এই অপরাধীদের ধরে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও এ দেশের মানুষের মানবিক অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে বারবার দুর্বৃত্তদের হাতে। বারবার জনগণকে জিম্মি করা হচ্ছে। রবি ও সোমবার সড়ক-মহাসড়কে শুধু মানুষই জিম্মি হয়নি, জিম্মি করা হয়েছে পুরো দেশকে। সন্ত্রাসের মাধ্যমে অচল করা হয়েছে চট্টগ্রাম, মোংলা, বেনাপোল বন্দরও। এমন তৎপরতাকে স্পষ্টত দেশদ্রোহিতা বলাই সঙ্গত।

আমরা আন্দোলন-সংগ্রামের বিপক্ষে নই। আমরা আন্দোলন-সংগ্রামের বলিষ্ঠ সমর্থক। এ দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার, যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতির অর্জন স্বাধীন-সার্বভৌম এই দেশমাতৃকা- সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘আমার জনগণের যাতে কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবা।’
আর আজ সেই স্বাধীন দেশেই ঘটছে তার উল্টোটা। দুর্বৃত্তরা আন্দোলনের নামে দেশের মানুষের গায়ে হাত তুলছে। তারা কালি মেখে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের গায়ে, শিক্ষার্থীদের মুখে। তাদের হাতে পোড়া মবিলে কালিমালিপ্ত আজ প্রিয় স্বদেশ।
প্রতিদিন দেশের সড়ক-মহাসড়কে ঝরে পড়ছে অসংখ্য প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু যে যাত্রী মরছেন, চালক বা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা মারা যাচ্ছেন, তা তো নয়। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যেমন যাত্রী মারা যাচ্ছেন, তেমনি মারা যাচ্ছেন যানচালক ও সহকারীরাও।

সড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনা ঘটছে অনেক কারণেই। তা কমিয়ে আনতে পারে সুদক্ষ চালকের সযত্ন যান চালনা। মূলত সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থেই সরকার ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করেছে। এ আইন প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে সড়ক পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক, মালিক ও মন্ত্রীরা এবং এ আইনের উপকারভোগী সব পক্ষের মতামত পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তা সত্ত্বেও এ আইনকে শ্রমিক স্বার্থপরিপন্থী বলে ৮ দফা দাবিতে ডাকা হয়েছে ধর্মঘট।
স্বয়ং আইনমন্ত্রী এ আইন সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তা সত্যিকার প্রণিধানযোগ্য। তার ভাষায়, ‘সড়ক পরিবহন আইন যেটা হয়েছে আমার মনে হয় সেটা সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সহায়ক হবে এবং চালকরা যদি সঠিকভাবে গাড়ি চালায়, তাহলে তাদের জন্য সহায়ক হবে। আইনে এমন কোনো প্রভিশন (বিধান) নেই যে, তারা অন্যায় না করা সত্ত্বেও তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হবে। আমি তাদের আহ্বান জানাব, তারা যেন এ পথ পরিহার করে।’

এই ধর্মঘটকে শ্রম আইনপরিপন্থী ও অবৈধ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছে পরিবহন শ্রমিক লীগ। ধর্মঘটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। সারা দেশে শ্রমিক ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে যাত্রী অধিকার আন্দোলন।
‘হরতাল’, ‘অবরোধ’ এসব অহিংস আন্দোলনের যিনি প্রবর্তক সেই মহাত্মা গান্ধী অহিংস এই আন্দোলনের সময় একজনকে হত্যা করা হয়েছিল বলে আন্দোলনই প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আর তার প্রবর্তিত সেই ‘অহিংস আন্দোলন’কে এ দেশে সহিংস ও বর্বর করে তোলা তো হয়েছেই, উপরন্তু সেই সহিংসতার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে সর্বত্র।

দেশে আইন প্রণীত হয় দুষ্টের দমন আর শিষ্টের প্রতিপালনে। প্রণীত আইনে যদি উপকারভোগীদের স্বার্থ ব্যাহত হয় তবে তা নিয়ে ভিন্নমত প্রদান, প্রতিক্রিয়া জানাতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আইন হাতে তুলে নেয়ার এমন নজির কোনোভাবেই মানা যায় না।
আমরা চাই বারবার দেশের মানুষকে জিম্মি করার এ ধারার অবসান। আমরা চাই যেন আর কোনো শিশুর এমন অ্যাম্বুলেন্স আটকের কারণে মৃত্যু না ঘটে। আর কোনো মানুষের মুখে যেন এমন বর্বরতায় কালি লেপন করা না হয়।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/106187