ছবি: কালের কণ্ঠ
২৯ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১১:১৩

বেআইনি ধর্মঘটে আধিপত্যের মহড়া!

সড়ক পরিবহন আইনে অপরাধ জামিনযোগ্য করা এবং জরিমানা কমানোসহ আট দাবিতে সারা দেশে গতকাল রবিবার ‘কর্মবিরতি’ শুরু করেছে পরিবহন শ্রমিকরা। কর্মসূচির নাম ‘কর্মবিরতি’ দেওয়া হলেও বাস্তবে সর্বাত্মক ধর্মঘটই শুধু নয়, রাস্তায় রীতিমতো অরাজকতা চালাচ্ছে তারা। ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরবাইক, সরকারি যানবাহন, এমনকি অ্যাম্বুল্যান্স চলাচলেও বাধা দিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। গাড়িচালক থেকে শুরু করে সাধারণ যাত্রীদের মুখে-গায়ে কালি লাগিয়ে নাজেহাল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ঘোষিত এই কর্মসূচির নাম ‘কর্মবিরতি’ দেওয়া হলেও সেটিও আইনসিদ্ধ নয় বলে জানিয়েছেন শ্রম অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা, এমনকি কোনো কোনো শ্রমিক নেতাও। যানবাহনের রুট পারমিট দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ জন্য রয়েছে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি বা আরটিসি। ওই কমিটিতে পুলিশ প্রশাসনের প্রতিনিধিও থাকেন। এবার ‘কর্মবিরতি’ ডাকার ক্ষেত্রে এসব সংস্থাকে দাবিনামা জানানো হয়নি। যেকোনো অন্যায়ের জন্য বিআরটিএ থেকে অনুমোদন দেওয়া বাসের মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে আরটিসি। আগাম নোটিশ না দিয়ে ধর্মঘট ডাকা হলে আরটিসি রুট পারমিট বাতিল করতে পারে।

জানা গেছে, এবারের কর্মসূচির নেপথ্যে আছে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর পেশিশক্তি প্রদর্শনের আগের রীতির ধারাবাহিকতা, প্রতিপক্ষকে দমাতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। কর্মসূচি আহ্বানকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন দেশের পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণকারী সবচেয়ে বড় সংগঠন। এর অধীনে শ্রমিক ইউনিয়ন আছে ২৩৩টি। এই ফেডারেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গত ৭ থেকে ৯ অক্টোবর ঢাকা বিভাগে পণ্য পরিবহনে কর্মবিরতি পালন করেছিল বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। ৯ অক্টোবর বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মবিরতি স্থগিত করা হয়েছিল। তাদের প্রধান দাবি ছিল সড়ক পরিবহন আইনের অপরাধ জামিনযোগ্য করা এবং জরিমানা কমানো।

বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক হলেন মো. মকবুল হোসেন। তাঁর ডাকেই ৭-৯ অক্টোবর কর্মসূচি পালিত হয় ঢাকা বিভাগে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন পরিবহন সংগঠন। সরকারের পক্ষে অবস্থানকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারাও তাতে সায় দেননি। এমনকি মকবুলকে পরিবহন নেতা মানতেও রাজি হননি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীও কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, মকবুল কোনোভাবেই পরিবহন নেতা নন।

সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ গত ৭ অক্টোবর রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় সমাবেশ করে সড়ক পরিবহন আইনে অপরাধী চালকদের শাস্তি ও জরিমানা কমানোসহ আট দাবিতে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল সরকারকে। দাবি না মানা হলে ১৩ অক্টোবর থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের পক্ষের নেতা সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়ায় সেই কর্মবিরতি পালন করা হয়নি। ওসমান আলী দেশে ফিরে প্রথমে সিলেটে বিভাগীয় শ্রমিক সমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবর থেকে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা সফর শেষে গত শনিবার ঢাকায় মহাসমাবেশ থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন।

গতকাল শুরু হওয়া কর্মবিরতিতে একাত্মতা প্রকাশ করেননি বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মো. মকবুল হোসেন। গত রাতে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিজেরা জেদ করে এই কর্মবিরতি পালন করছে ফেডারেশন। কিন্তু তাদের সংগঠনের ও সমমনা সংগঠনের দুজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস হয়েছে। তাঁরা তখন প্রতিবাদ করেননি। এই ফেডারেশনের শ্রমিক নেতারা আগে নীরব থেকে এখন কর্মবিরতি পালন করছেন আধিপত্য ও ক্ষমতা দেখাতেই। তাঁরা প্রাইভেট কার, রিকশাও ভাঙচুর করছেন। আমাদের ট্রাক, ট্যাংক লরিও চলতে দিচ্ছে না।’

আইনবিরোধী কর্মবিরতি : শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শিবনাথ রায় শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকার দিকে ফেরার পথে স্থানে স্থানে বাধার মুখে পড়ছিলেন। আশুগঞ্জে অবস্থানকালে গতকাল বিকেলে তিনি ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের কর্মবিরতিতে যেতে হলে শ্রমিক সংগঠনকে স্থানীয় শ্রম দপ্তরে গিয়ে দাবি অবহিত করতে হয়। সারা দেশের শ্রমিকদের দাবি হলে সে ক্ষেত্রে শ্রম অধিদপ্তরের কাছে তা তাদের অবহিত করতে হয়। তারপর শ্রম অধিদপ্তর বিষয়গুলোর মীমাংসার জন্য আলোচনায় বসবে। সরকারের পক্ষে শ্রম অধিদপ্তর বিবদমান বিষয়গুলোর সমাধান করতে ব্যর্থ হলে আলটিমেটাম দিতে পারে শ্রমিকরা। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানা হলে কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি পালন করা যায়। কিন্তু এবার পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন আইন অনুসারে আমাদের কাছে আসেনি। বিষয়গুলো আমরা জানি না। তাতে হঠাৎ করে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। আমরা পরিবহন নেতাদের শ্রম আইন সম্পর্কে জানাতে বহুবার সভা করেছি। তার পরও তাঁরা আইন না মেনে এ ধরনের কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। এটা আইনবহির্ভূত।’

শিবনাথ রায় বলেন, ‘নিবন্ধিত কোনো সংগঠন ধর্মঘট আহ্বান করলে শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে তা শ্রম অধিদপ্তরকে অবহিত করার আইন মানা হচ্ছে না। সংক্ষুব্ধদের দাবিনামাসহ ত্রিপক্ষীয় একটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে না। আলোচনায় সুরাহা না হলে এ কর্মবিরতি করলে তার যৌক্তিকতা থাকত। আইন অনুসারে, কর্মবিরতিতে যেতে হলে শ্রমিকদের দাবিনামা জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, ঢাকা মহানগর পুলিশ ও বিভিন্ন জেলা পুলিশ কার্যালয়ে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কর্মবিরতি আহ্বানের ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রমিক ইউনিয়ন বা ফেডারেশনকে সাধারণ সভা আহ্বান করতে হয়। সাধারণ সভায় উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ধর্মঘটের পক্ষে ভোট দিলে ১৫ কর্মদিবসের আলটিমেটাম দিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দাবিনামা পেশ করতে হয়। পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ন্যায়সংগত দাবি মেনে না নিলে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন ধর্মঘট আহ্বান করতে পারে। কিন্তু এবার কর্মবিরতি আহ্বান করা হয়েছে এসব বিধি উপেক্ষা করে। তার নেপথ্যে আছে আধিপত্য দেখানো।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এক মাস আগেই প্রধানমন্ত্রী, সড়কমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। কোনো ফল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে কর্মবিরতিতে যেতে হয়েছে।’ সড়ক পরিবহন আইন পাস হওয়ার আগে নীরব ছিলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সাধারণ শ্রমিকরা কিছুই জানতাম না। আমাদের অজান্তে তা পাস করা হয়েছে।’

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কয়েক দিন হঠাৎ সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট পালন করা হয়েছিল। তার নেপথ্যে ছিল এই ফেডারেশন ও সমমনা সংগঠনগুলো। এবার ডাকা হলো কর্মবিরতি।
মন্ত্রণালয় থেকে ডাক না পেলে কর্মবিরতি চলবে : ওসমান আলী গত রাতে বলেন, ‘এক মাস আগে দাবির বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে সাড়া পাইনি। ২০১৩-১৪ সালে আমরা জীবন দিয়ে বিরোধী দলের অবরোধ ঠেকিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রাইভেট কার চালকের গালে কালি লেপেছে আমাদের বিরোধীরা। আমরা কোথাও ভাঙচুর করিনি। আমি আইন সংশোধনের জন্যই কর্মবিরতিতে নেমেছি। আমাদের সারা দেশেই শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। আগে যারা কর্মবিরতি করেছিল তাদের পরিবহন নেতা বলা যায় কি না যাছাই করে দেখতে পারেন।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/10/29/697160