২৯ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:৪৫

দেড় কিলোমিটার লাইনের জন্য একজন পরামর্শক

বিদেশী পরামর্শকদের বেতন মাসে ১০-১২ লাখ টাকা; কিমি. প্রতি ব্যয় ২৫ কোটি টাকা

পরামর্শকের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে রেলের প্রকল্প। পরামর্শক ও ভূমি অধিগ্রহণের কারণে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয় বেশি হচ্ছে। পরামর্শক খাতে প্রকল্প ব্যয়ের বিদেশী অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণে প্রতি ১.৬১ কিলোমিটারে একজন করে পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু এই প্রকল্পেই দেশী-বিদেশী মিলে ৬১ জন পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। লাইন নির্মাণে কিলোমিটারে ব্যয় হবে ২৫ কোটি ১৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। পরামর্শকদের জন্য ব্যয় হবে ৯২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে। আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গ থেকে রাজধানী ঢাকার রেলপথ দূরত্ব কমিয়ে চলাচলের সময় হ্রাস করার জন্য বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাবনা দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ভারতীয় তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ ১৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে ভারত সরকার থেকে ঋণ পাওয়া যাবে তিন হাজার ১৪৬ কোটি ৫৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা। আগামী ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্প সমাপ্ত করার কথা। প্রকল্পটি প্রায় বছরখানেক আগে পিইসি হয়ে পড়েছিল।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ৮৬ দশমিক ৫১ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ মেইন লাইন এবং ১৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ লুপলাইনসহ মোট ১০২ দশমিক ৮১ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করতে হবে। এতে সার্বিকভাবে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৫৮৯ কোটি ৭০ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়বে ৫৪ কোটি ২৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা। আর শুধু ট্র্যাক বা লাইন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫৮৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এই হিসাবে প্রতি কিলোমিটার ট্র্যাক নির্মাণ ব্যয় পড়ছে ২৫ কোটি ১৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা।
আর এই ১০২ দশমিক ৮১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে দেশী ও বিদেশী মোট পরামর্শক ধরা হয়েছে ৬১জন। এ ছাড়াও রয়েছে আইটি পরামর্শক। ওই ৬১ জনের পেছনে মোট ব্যয় হবে ৬৮ কোটি ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এখানে ১৪ জন বিদেশী পরামর্শক থাকবে। যাদের জন্য ব্যয় হবে ২৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তাদেরকে প্রতি মাসে বেতন দিতে হবে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা হারে। আইটি পরামর্শকদের জন্য ব্যয় হবে ২৪ কোটি ৮৬ হাজার টাকা। আর প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯৬০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। ফলে প্রতি একর জমির দর পড়বে ১২ কোটি টাকা। এখানে ১০টি স্টেশন নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭২ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।

উল্লেখ্য, ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ভারতে সাধারণ সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে গড়ে ব্যয় হয় ১৩ কোটি টাকা। পাকিস্তানে এই ব্যয় কিলোমিটারে ১৬ কোটি টাকা। চীনে ট্রেন চলাচলের জন্য ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৫ কোটি টাকা। আর সাধারণ সিঙ্গেল রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, ১৯৯০ সালে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি মিটারগেজ লাইন নির্মাণের বিষয়ে লোকেশন সার্ভে করা হয়। ১৯৯৬ সালে এর ওপর ফলোআপ স্টাডি করা হয়। প্রায় ২০ বছর আগে সম্পাদিত লোকেশন সার্ভের ওপর ভিত্তি করে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কমিশন বলছে, পরামর্শকদের খাতে প্রতি মাসে বেতন হিসেবে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এই খাতের ব্যয়গুলো পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ৬০ জন জনবলের জন্য বেতন ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। জনবল নির্ধারণ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জনবল সংখ্যা ও বেতন ভাতা নির্ধারণ করতে হবে।

এ ব্যাপারে সম্প্রতি বিশ^ব্যাংকের ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রকল্প তৈরিতে কোয়ালিটি কাজ করছে না। যার যা খুশী নিজেদের মতো করে ব্যয় নির্ধারণ করছে। বিদেশে এক টাকার জায়গায় চার টাকা ব্যয় হলেও কাজ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে সেটাও হচ্ছে না। এখানে খাতাপত্রে ব্যয় দেখানো হচ্ছে। পরে বিল দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদেশী ঋণের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার হলে দেশের প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব হতো। এতে রাজস্বও বাড়ত। সরকারও তা থেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারত। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমরা সক্ষমতা হারাব। বিদেশী ঋণও পরিশোধ করতে পারব না।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/360684