২৯ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:২৩

অক্টোবর : দেশ ও জাতির সর্বনাশের দিন

আশিকুল হামিদ : বার্ষিক কোনো ‘দিবস’ পালনের পক্ষপাতী না হলেও ২৮ অক্টোবর তারিখটিকে স্মরণ না করে পারা যায় না। কারণ, দিনটি হত্যা ও নিষ্ঠুরতার জন্য চিহ্নিত ও স্মরণীয় হয়ে আছে। ২০০৬ সালের এই দিনে লগি-বৈঠার তা-বের মাধ্যমে হত্যা, নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার ভয়ংকর অভিযান চালানো হয়েছিল। ক্ষমতার লোভ এবং ক্ষমতায় যেতে না পারার আফসোস কোনো দল ও তার নেতৃত্বাধীন কোনো জোটকে কতটা হীন ও নিষ্ঠুর করতে পারে, তারই এক ভয়ংকর উদাহরণ হয়ে আছে ২৮ অক্টোবর। অথচ দিনটি জাতির জন্য উৎসবের দিন হয়ে ওঠার কথা ছিল। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী সেদিনই চার দলীয় জোট সরকার প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। ফলে ২০০১ সাল থেকে সরকার চালিয়ে আসা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আর ক্ষমতাসীন দলের অবস্থানে ছিল না। দল দু’টি ফিরে গিয়েছিল অন্য সকল রাজনৈতিক দলের সমান কাতারে। বিএনপি ও জামায়াতের ঘোষিত কর্মসূচিও ছিল আর দশটা দলের মতো। আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করেছিল। বিএনপি নয়াপল্টনে এবং জামায়াত বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

জামায়াতের কর্মীরা তখন বিকেলে অনুষ্ঠেয় সমাবেশের মঞ্চ তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কোনো মিছিল বা পাল্টা মিছিল বা সংঘাত হয়নি সে সময়। তা সত্ত্বেও আচমকা হামলা চালিয়েছিল লগি-বৈঠাধারীরা। লগি-বৈঠার আঘাতে একের পর এক ছয়জন তরতাজা যুবক রাজপথে ঢলে পড়েছিল। এরপর শুরু হয়েছিল নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার উন্মত্ত কর্মকা-। মৃত্যু নিশ্চিত করেও থেমে যায়নি ঘাতকের দল। রক্তাক্ত মৃতদেহের ওপর নৃৃত্য করেছে তারা। রক্ত হিম করা এসব দৃশ্য দেখেছে দেশ ও বিদেশের মানুষ। দেখে মানুষ মাত্রই স্তম্ভিত হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ঘটনা মোটেও বিচ্ছিন্ন ছিল না। ঘাতকরা একই বিশেষ কেন্দ্রে ট্রেনিং পেয়েছিল। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাও ছিল যথেষ্ট ইঙ্গীতপূর্ণ। দীর্ঘ আট ঘণ্টা ধরে হাজার হাজার ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ ও টিভি ক্যামেরার সামনেই অভিযান চালিয়েছিল লগি-বৈঠাওয়ালারা। কিন্তু তারপরও এবং জামায়াত নেতারা উপর্যুপরি অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও পুলিশ এগিয়ে আসেনি। যেন হত্যা করার জন্য আগেই লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল লগি-বৈঠাওয়ালাদের!
লগি-বৈঠার তা-ব ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে শুধু নয়, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহেও এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সবকিছুর পেছনে ছিল একই পরিকল্পনা। প্রধান কারণ ছিল পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েও চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দিতে না পারার দুঃখ এবং আগামীতেও ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হবে না বলে পাওয়া আগাম সংবাদ। কথাটা বলার কারণ, নির্বাচনে অংশ নেয়ার সামান্য ইচ্ছা থাকলেও যে কোনো দলেরই তখন নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে ওঠার কথা। অন্যদিকে প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার পাশাপাশি দাবির পর দাবি তুলে আওয়ামী লীগ এবং তার সঙ্গীরা একদিকে ঝামেলা পাকিয়েছে, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও করেছে বাধাগ্রস্ত। অসাংবিধানিক এবং অযৌক্তিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক প্রতিটি প্রধান দাবি পূরণ করার পরও আওয়ামী জোট ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিটি উদ্যোগকেই তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী জোটের পক্ষ থেকে বঙ্গভবন অবরোধ ও বঙ্গভবনের ‘অক্সিজেন’ বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এমনকি গৃহযুদ্ধেরও ভয় দেখিয়েছিলেন। সব মিলিয়েই আওয়ামী জোটের উদ্যোগে পরিস্থিতিকে অত্যন্ত বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছিল।

লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের কারণ বুঝতে হলে জেনারেল মইন উ আহমেদের অঘোষিত নেতৃত্বে এবং ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক নামের পরবর্তী সরকারের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে- যে সরকার ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসেছিল। বিচ্ছিন্ন বিচারে মনে হতে পারে যেন তারা ঘটনাক্রমে ক্ষমতায় এসেছিলেন- যেন পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছিল! বিভিন্ন সময়ে তারা নিজেরাও অমন ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। অন্যদিকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে, ফখরুদ্দিনদের আসলে ‘নিয়ে আসা’ হয়েছিল। এনেছিল বিশেষ দু’তিনটি দেশ এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ভালো ভালো অনেক নীতিকথা ও আশ্বাসের আড়ালে এসব দেশ ও সংস্থার তৈরি করা ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন ফখরুদ্দিনরা। ক্ষমতার লোভে সহযোগিতা করেছিল আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গীরা। ‘আন্দোলনের ফসল’ কথাটাও তখন থেকেই মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল।

কারা, কেন এই ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করেছিল, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে যদি কিছু তথ্য স্মরণ ও বিশ্লেষণ করা যায়। এ প্রসঙ্গে প্রথমে চারদলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি কঠোর ভাষণের উল্লেখ করা দরকার। ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ জাতীয় সংসদে দেয়া সমাপনী ভাষণে কোনো দেশের নাম না নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কারো চোখ রাঙানিকে ভয় করে না, বাংলাদেশ কারো নির্দেশে চলবে না।’ বেগম খালেদা জিয়া সেই সাথে রাজনীতিসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করার জন্যও কঠোর উচ্চারণযোগে বিদেশীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। তার অভিযোগ ছিল, প্রধানমন্ত্রী নাকি বাংলাদেশকে ‘বন্ধুহীন’ করার চক্রান্ত করেছেন! উল্লেখ্য, এর মাত্র কিছুদিন আগে অনেকটা আকস্মিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল আওয়ামী লীগ। ‘রোডম্যাপ’ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হিসেবে এই প্রস্তাব এবং তার ভিত্তিতে আন্দোলন ও মহাজোট গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কথা মনে রাখতে হবে। ঘটনাপ্রবাহের ওই বিশেষ পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিজা রাইসের একটি মন্তব্যও স্মরণ করা দরকার। ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ভারত সফরকালে কন্ডোলিজা রাইস ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে’ এবং এই প্রক্রিয়ায় ভারতকে ‘সঙ্গে রাখবে’। বাংলাদেশকে ‘অত্যন্ত সমস্যাপূর্ণ রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে কন্ডোলিজা রাইস আরো বলেছিলেন, সেখানে ভারতকে ‘সঙ্গে নিয়ে’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ ভূমিকা’ পালন করার দায়িত্ব রয়েছে। এখানে যে রোডম্যাপের কথা বলা হচ্ছে, তার উদ্দেশ্য বুঝতে হলে কন্ডোলিজা রাইসের ঘোষণা ও মন্তব্যকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর দৃশ্যপটে এসেছিলেন সেদেশেরই ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে. টমাস। ২০০৫ সালের ১৪ জুন হ্যারি কে. টমাস এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যদি সমঝোতায় না আসে ও এক সঙ্গে কাজ না করে, তাহলে জনগণ বিকল্প খুঁজবে। আর সেটা কারো জন্যই ভালো হবে না।’ এই ‘বিকল্প শক্তি’র পরিচিতি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রদূত টমাস বলেছিলেন, ‘আপনারা তা দেখতে পাবেন।’ তিনি আরো বলেছিলেন, আমরা জানি, রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি অন্য শক্তিও দেশের শাসন ক্ষমতা নেয়ার চেষ্টা করে।
এর ক’দিন পর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে হ্যারি কে. টমাস এক বাক্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বিকল্প শক্তি’ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা ‘ঠিকই’ বলেছেন। ‘রোডম্যাপ’-এর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে হলে হ্যারি কে. টমাসের কথাগুলোকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে।

এবার লন্ডন প্রবাসী আওয়ামী কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর কিছু কথা উল্লেখ করা দরকার। লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে গিয়ে বিভিন্ন ‘সূত্র’ থেকে অবহিত হওয়ার পর এক নিবন্ধে তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘স্থিতিশীলতা’ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে। পাকিস্তানের দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর উদাহরণ টেনে গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেহেতু ‘স্থিতিশীল’ বাংলাদেশ দরকার এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কারণে যেহেতু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না, যুক্তরাষ্ট্র সেহেতু এই দু’জনকে বেনজীর ভুট্টো ও নওয়াজ শরীফ বানিয়ে ফেলতে পারে।
সে সময়ের আরো দু’একটি তথ্যও স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। প্রথম তথ্য হলো, ঠিক ওই দিনগুলোতেই বিশেষ কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজী দৈনিকে অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংসদে যোগ দেয়া-না দেয়া সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে নতুন পর্যায়ে ‘জনমত’ গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিষয়টিকে অবশ্যই ‘কাকতালীয়’ বলা যায় না। দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, সে সময়ই হঠাৎ টিআইবি এক রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছিল, অষ্টম অর্থাৎ ওই সময়ে বিদ্যমান জাতীয় সংসদের প্রথম তিনটি অধিবেশনে কেবল কোরাম সংকটের কারণে অপচয় হয়েছে দুই কোটি ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এসব তথ্য-পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে এমপি বা জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। তৃতীয় তথ্যটি হলো, অপব্যয় ও সংসদে যোগ না দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একই সময়ে বিশ^ ব্যাংক ও দাতারা সাহায্যের পূর্বশর্ত হিসেবে এমপিদের জন্য আচরণবিধি তৈরি ও কার্যকর করার কথা জুড়ে দেয়া শুরু করেছিল।
‘রোডম্যাপ’ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই তথ্যের সংখ্যা আর বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে. টমাসের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল। ‘বিকল্প শক্তি’ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা তা দেখতে পাবেন’। বাংলাদেশের জনগণকে সত্যি সত্যি ‘তা’ দেখতে হয়েছিল। দুই নেত্রীকে বিতাড়িত করার আয়োজন সংক্রান্ত যে খবর গাফফার চৌধুরী জানিয়েছিলেন সেটাই ১/১১-পরবর্তী মাসগুলোতে ‘মাইনাস টু থিওরি’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, ‘রোডম্যাপ’ তৈরি হয়েছিল ২০০৫ সালের প্রথম দিকে কিংবা তারও আগে। কোন দেশ ঠিক কোন দেশকে ‘সঙ্গে’ নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘পদক্ষেপ’ নিয়েছিল সে কথাও জানা গিয়েছিল সহজেই। সমগ্র এ ঘটনাপ্রবাহে নির্ধারক হিসেবে এসেছিল আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গীদের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব। সঙ্গে ছিল তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং বিশেষ কয়েকটি দৈনিক ও বেসরকারি টেলিভিশন।

জোট সরকারের পাঁচ বছরে বিরোধী দল হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেনি বলে আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থাও অর্জন করতে পারেনি। নিজেদের তো বটেই, ‘বন্ধুরাষ্ট্র’সহ কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। মূলত এই হতাশা থেকেই আওয়ামী লীগ দেশকে হ্যারি কে. টমাস বর্ণিত ‘দুর্ভাগ্যজনক’ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এজন্যই শুরু হয়েছিল লগি-বৈঠার তা-ব, যা শেষ পর্যন্ত ১/১১-কে অনিবার্য করেছিল। এটা যে সুপরিকল্পিত এক আয়োজন ছিল সে কথাও প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেরাও প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ড. ফখরুদ্দিনের সরকারকে তারাই এনেছিলেন। ওই সরকার ছিল তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’।
বলা দরকার, আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি করাই শুধু ১/১১-এর উদ্দেশ্য ছিল না। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি ও জামায়াতসহ বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোকে বাধাগ্রস্ত ও পর্যুদস্ত করা, সম্ভব হলে একেবারে নির্মূল করে দেয়া। এই একটি ক্ষেত্রে চিন্তায় অবশ্য ভুল করেছিল অন্তরালের শক্তিগুলো। প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে জামায়াতের মতো ইসলামী কোনো দলকে তো বটেই, বিএনপির মতো ইসলামী ভাবধারার দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী একটি দলকেও ধবংস করা সম্ভব নয়।

ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে হতাশ আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গীদের নিয়ে নির্বাচন ভ-ুল করা এবং জাতির ওপর একটি অনির্বাচিত সরকার চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল সত্য, কিন্তু ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করা যায়নি। এই শক্তি বরং অনেক বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে পরবর্তী দিনগুলোতে। প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বর্তমানেও। ফাঁসিসহ কঠোর দমন-নির্যাতনের মুখেও জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। বিএনপিও রয়েছে ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলের অবস্থানে।
এটা নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমিকদের বিরাট অর্জন। অর্থাৎ লগি-বৈঠার হত্যা, নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার প্রধান উদ্দেশ্যই সফল হতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের ইতিহাসে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর স্মরণীয় হয়ে আছে একটি ভয়ংকর কালো দিন হিসেবে।

http://www.dailysangram.com/post/351275