২৫ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৪

রোহিঙ্গাদের ঋণসহায়তার ১২৭ কোটি টাকা পরামর্শকদের পেটে

বেশির ভাগ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে সাহায্য আনা হচ্ছে। বিদেশী সহায়তার টাকা চলে যাচ্ছে পরামর্শকদের পেটে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পরামর্শকের ভারেই যেন এগোতে পারে না। পরামর্শক খাতে ব্যয় ও সম্মানী খাতের মাধ্যমে অর্থগুলো পকেটস্থ হচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীরা সহায়তা দিয়ে তা নিজস্ব পরামর্শকের মাধ্যমে টাকাগুলো ভিন্নভাবে নিজেরাই নিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় মাল্টি-সেক্টর শীর্ষক প্রকল্পে শুধু পরামর্শক খাতে ব্যয় হবে ১২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী পরামর্শক খাতে এই ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবনা তথ্য থেকে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন এস্টেটে নিপীড়িন-নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে আগত আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তারা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের আগমনের কারণে ওই উপজেলার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া এই এলাকা অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় গড় সূচকে পিছিয়ে আছে। ফলে বিদ্যমান অবকাঠামো, অপ্রতুল সামাজিক সেবা প্রদান ব্যবস্থা, সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্য বিধান ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর অপরিসীম চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এতে এলাকাটি বিভিন্ন কারণে অতিমাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সহায়তা প্রদান করলেও তা সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত।

বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রাক্কলিত ব্যয়ে কর্মসূচি গ্রহণের প্রক্রিয়া করে। প্রকল্পের কর্মসূচি এলজিইডি, এফএসসিডি, ডিপিএইচই এবং এমওডিএমআর এই চারটি সংস্থার আওতাভুক্ত। মোট এক হাজার ৫৮ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন এক হাজার ৪৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বাকি ৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা হলো জিওবি। এই কর্মসূচির দু’টি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) অধীনে দু’টি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। একটি প্রকল্প এমওডিএমআর এবং বাকিটি তিনটি সংস্থা এলজিইডি, এফএসসিডি, ডিপিএইচইর মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পটি এ বছর অনুমোদন পেলে আগামী তিন বছরে তা সমাপ্ত করা হবে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হলো, ২৩টি সাইকোন শেল্টার নির্মাণ, ৩০টি বহুমুখী কমিউনিটি সেবা কেন্দ্র নির্মাণ, ২০৩.৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ১৭.১৫ কিলোমিটার সড়ক মজবুত ও প্রশস্তকরণ, ক্যাম্পের ভেতরে ২৫ কিলোমিটার সড়ক, ফুটপাথ ও ড্রেন নির্মাণ, ৩৪৫ মিটার ব্রিজ নির্মাণ, ৩৭৫ মিটার কালভার্ট নির্মাণ, ২ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, পাঁচটি হাটবাজার উন্নয়ন, ২৮টি টিউবওয়েল, অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র রাখার ৯টি স্যাটেলাইট কেন্দ্র, একটি রিলিফ কেন্দ্র, ২৮টি মিনি পাইপে পানি সরবরাহ, ৭০টি কমিউনিটি ল্যাট্রিন, ৪০০টি ওয়াটার অপশন স্থাপন, ৩০টি বায়োগ্যাস ল্যাট্রিন, তিন হাজারটি পয়ঃ ও কঠিন ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ৫০০টি বাসায় বায়োফিল টয়লেট স্থাপন করা হবে।
প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এলজিইডির পরামর্শক খাতে ২৯ কোটি ৭৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা, এলজিইডির মনিটরিং ও মূল্যায়ন পরামর্শক খাতে চার কোটি টাকা, এলজিইডির কমিউনিকেশন ফার্মকে তিন কোটি টাকা, এলজিইডির অন্য ফার্মকে চার কোটি ১০ লাখ টাকা, ডেজন্ডারভিত্তিক ভায়োলেন্স ব্যবস্থাপনা ফার্ম ৭৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া পানি স্যানিটেশন স্কিম পর্যবেক্ষক খাতে ২০ কোটি টাকা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জন্য পরামর্শক ডিপিএইচইর খাতে ১১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। আর ২৩টি নতুন শেল্টার নির্মাণে যাবে ৯২ কোটি টাকা, ৩০টি সেবাকেন্দ্র নির্মাণে সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা, সড়ক উন্নয়নে ২৫৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, সড়ক মজবুতে আট কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ক্যাম্পের ভেতরে রাস্তা, ফুটপাথ ও ড্রেন নির্মাণে ১৮ কোটি টাকা, ব্রিজ নির্মাণে ৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২৮টি পানি সরবরাহ পাইপের জন্য ৫৬ কোটি টাকা, ৭০টি ল্যাট্রিনের জন্য ১৪ কোটি টাকা, পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ৩৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, বাড়িতে টয়লেট স্থাপনে ১৮ কোটি টাকা ইত্যাদি।

বিভিন্ন প্রকল্প পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, ইনকুসিভ সিটি গভর্নেন্স প্রকল্প পরামর্শকদের ভারে নুব্জ্য ছিল। একটি মাত্র প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয় ১২৯ জন। আর তাদের পেছনে ব্যয় ছিল ৩১৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প তৈরির জন্য কারিগরি প্রকল্পে ১৫০ জন পরামর্শক রাখা হয়। তাদের পেছনে ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয় ১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এতে প্রতি পরামর্শক পাচ্ছেন গড়ে ১০ লাখ টাকার বেশি। এই দুই প্রকল্পে পরামর্শক হলো ২৭৯ জন। তাদের ভারেই প্রকল্প ন্যুয়ে পড়েছে। ইনকুসিভ সিটি গভর্নেন্স প্রকল্পে পরামর্শকদের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। গ্রামীণ অবকাঠামো প্রকল্পে পরামর্শকদের পেছনে ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া রেলের খুলনা-দর্শনা প্রকল্পে ৬৩ জনে ১০৩ কোটি টাকা, পার্বতীপুর-কাউনিয়া প্রকল্পে ৫৩ জনে ৬০ কোটি টাকা এবং মধুখালী-মাগুরা প্রকল্পে ১৬ জনে প্রায় ৩১ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে। আর দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৭ কিলোমিটার লাইনকে ডুয়েলগেজ (ডিজি) করতে বিদেশী ও দেশী মোট ৫৩ জন পরামর্শক। তাদের প্রতিজনের জন্য এক কোটি টাকার বেশি ব্যয় হবে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এই ধরনের প্রকল্পে এত টাকা পরামর্শক খাতে ব্যয় করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কাজের ধরন পর্যালোচনা করে যেসব পরামর্শক একান্ত প্রয়োজন সেগুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর এই খাতে ব্যয়ও কমিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন আইটেমের একক ব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। পূর্ত কাজের একক ব্যয় যৌক্তিকপর্যায়ে আনা দরকার।

 

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/359654