২৫ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২১

সুর-অসুরের সেই দ্বন্দ্ব

জীবনে আনন্দের সাথেই যেন জড়িয়ে থাকে বিষাদ! এ কারণেই হয়তো আমাদের সমাজে ‘হরিষে বিষাদ’ কথাটির এত প্রচলন। ছোটবেলা থেকেই ঘরে-সমাজে আনন্দে মত্ত হওয়ার সময় আমরা শুনে এসেছি- সাবধানে, নয়তো বিপদ হতে পারে। অর্থাৎ বার্তাটি হলো- জীবনে শুধু সুখ নয়, দুঃখও আসতে পারে। অতএব সাবধান থেকো, সতর্ক থেকো। আরও বলা হয়- সাবধানের মার নেই।
এত বার্তা ও সাবধান বাণীর পরও মানব জীবনে, মানব সমাজে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। যেমন ১৯ অক্টোবর ঘটে গেছে ভারতের অমৃতসরে। পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর জেলায় শুক্রবার এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ৫০ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের দশেরা উৎসব দেখতে রেললাইনের ওপর জড়ো হওয়া উৎসবমুখর জনতার ওপর ট্রেনটি উঠে গেলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। উপলব্ধি করা যায় এই দুর্ঘটনার মাত্রা ও চিত্র কতটা ভয়াবহ ছিল। এখানে বলার মতো আরো বিষয় হলো, মানুষজন যখন বুঝতে পারলো ট্রেন দ্রুতগতিতে তাদের দিকে ছুটে আসছে, তখন চূড়ান্ত রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, লোকজন এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু করার মধ্যেই আর একটি ট্রেন তাদের ওপর এসে পড়ে।

অমৃতসর থেকে এফপি পুলিশ ও প্রত্যক্ষণদর্শীর বরাত দিয়ে জানায়, প্রতিবছর দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর দিন অসুর বধের সময় সেখানে দশেরা উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এবারও উৎসব পালনের সময় আতশবাজির শব্দ ও চেঁচামেচির কারণে ট্রেনটি ধেয়ে আসার বিষয়টি টের পায়নি উল্লসিত জনতা। ফলে ঘটে যায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার পরপরই আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো শুরু হয়। আর পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক টুইট বার্তায় ঘটনাকে হৃদয়বিদারক বর্ণনা করে পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। আমরাও শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। তবে প্রশ্ন জাগে, আমাদের এই সমবেদনা ওদের বেদনাদীর্ণ অন্তরের ক্ষত শুকাতে কতটা সক্ষম হবে? আরও প্রশ্ন জাগে, দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে এখন তো তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু দশেরার মতো আবেগঘন এত বড় একটি ধর্মীয় উৎসব যখন রেললাইনে উপচে পড়ে, তখন সেখানে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কী? আসলে আবেগ থাকলেও আমাদের উপমহাদেশ ব্যবস্থাপনায় এখনও অনেক পিছিয়ে।
অমৃতসরের ঘটনায় মানব জীবনে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি আবার উঠে আসলো। মানুষ ধর্মকে ভালোবাসে, ধর্মে আনন্দ পায়, ধর্মে মুক্তি খোঁজে, ধর্মের জন্য জীবনও দিতে পারে। দুর্গাপূজায় অসুর বধের যে চেতনা তা ভেবে দেখার মতো। আর অসুর বধকে কেন্দ্র করেই তো দশেরা উৎসব। সুর-অসুরের এই দ্বন্দ্ব নতুন কোনো বিষয় নয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দেবতা ও দানবের দ্বন্দ্বের নিরীখে বিষয়টিকে বিবেচনা করে আসছেন।
আমরা জানি, জীবন ও জগৎ ভাবনায়, ধর্ম ভাবনায় মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে, বৈচিত্র্য আছে। এই পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়েও মানুষ যদি ধর্মের মূল লক্ষ্যকে উপলব্ধি করতে পারতো, ভ্রষ্টতা থেকে দূরে থাকতে পারতো, তাহলে আমাদের এই পৃথিবীটা আরো সুন্দর ও অর্থবহ হয়ে উঠতো। আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে আমরা ধার্মিকরা ধর্মের Ritual নিয়ে যতটা মাতামাতি করি, Spiritual নিয়ে ততটা মগ্ন হই না। এটা আমাদের এক দুর্বলতা। ফলে ধর্মের কাক্সিক্ষত সৌরভ থেকে আমরা হচ্ছি বঞ্চিত। আমরা কে কতটা মানুষ তাতো আমাদের কথাবার্তা ও আচরণে ফুটে ওঠে।
মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষ মর্যাদাবান হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মর্যাদাবান মানুষের কথা বা বক্তব্য কেমন হবে? মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় এই স্বাভাবিক বিষয়টি কতটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে? পৃথিবীর ক্ষমতাবান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডে তো সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটছে না, আর তাদের অনেকের বিদ্বেষপূর্ণ ও বিষাক্ত বাক্যবানে হতাশার মাত্রা আরো বাড়ছে। এমন বিশ্ববাতাবরণে কেউ কেউ পবিত্র কুরআনের বাণীতে সমাধান খোঁজার আহ্বান জানাচ্ছেন। উত্তম আহ্বান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কুরআন পাঠে প্রবৃত্ত হওয়ার আগে তো মানুষের চোখে পড়ছেন মুসলিম এবং তাদের সমাজ। মানুষ তো পড়ার চাইতে দেখতে বেশি ভালবাসে। মুসলমানদের দেখে কি বর্তমান সময়ে পবিত্র কুরআনের বার্তা উপলব্ধির খুব সুযোগ আছে? আর মুসলমানদের কথাবার্তা ও জীবনদৃষ্টি? দূষণে-মিশ্রণে বাস্তবতা এমন হয়েছে যে, মুসলমানদের অন্যদের থেকে আলাদা করা বেশ মুশকিল। অথচ পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য।’ মুসলমান তো আসলে তথাকথিত কোনো ‘সম্প্রদায়ের’ নাম নয়, বরং বৈশিষ্ট্যম-িত সচেতন মানবম-লীর নাম, যাদের লক্ষ্য শুধুই কল্যাণ। এই চেতনা এখন পৃথিবীতে কতটা বর্তমান আছে। মুসলমানদের কথাবার্তা বা বাক্য-বিন্যাসেই বা এর প্রতিফলন কতটা ঘটছে?

পবিত্র কুরআনে তো ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে সৃষ্টি জগতের জন্য ‘রাহমাতাললিল আলামিন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এখান থেকে তো আমরা মানুষের প্রতি, প্রাণীর প্রতি তথা পরস্পরের প্রতি দয়া-ভালবাসা, ¯েœহ-মমতার শিক্ষা পাই। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য কি বার্তা পাঠালেন, আর আমরা করছি কী? এমন প্রশ্নে হতাশা নয়, বরং প্রয়োজন আত্মসমালোচনা।
আর আত্মসমালোচনার দায়িত্বটা প্রথমেই পালন করতে হবে মুসলমানদের। তবে আদমশুমারির তালিকায় আমরা যারা মুসলিম, তারা এই দায়িত্ব কতটা উপলব্ধি করবো সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

http://www.dailysangram.com/post/350765