২৪ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৫১

দেশী-বিদেশী মহলের দাবি ‘অবাধ’ মহাজোট চায় ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন

সরদার আবদুর রহমান : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ হোক- দেশী-বিদেশী মহলের পক্ষ থেকে এই দাবী বারবার উচ্চারিত হলেও মহাজোটের ভরসা ৫ জানুয়ারির মডেলের একটি ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন। আর সেরকম না হলে অন্তত সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকেই ‘মডেল’ বা ‘কৌশল’ হিসেবে নিয়ে এগুতে চায় সরকারী মহল।

কেবল একটি তত্ত্বাবধায়ক নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করেছিলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। সেসময় একটি জননন্দিত ও বিপুলভাবে জনসমর্থিত ‘কেয়ারটেকার সরকার’ ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে নিজেদের একতরফা ও একচেটিয়া বিজয়ী হওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে আওয়ামী লীগ। এজন্য কোনপ্রকার নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করা হয়নি। এভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া কার্যত ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে শুরু হয় প্রতিপক্ষ দমনের এবং নির্মূলের যতোসব নির্মম পদ্ধতির বাস্তবায়ন। বিরোধীদের অভিযোগ, সামনে ২০১৯-এর জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারো ক্ষমতা হাতে পেতে শুরু হয়েছে নয়া পরিকল্পনা। এ পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের প্রধান লক্ষ্য, দন্ত-নখরবিহীন একটি প্রতিপক্ষ তৈরি করা। যাদের সঙ্গে লড়াই হবে একতরফা ও অসম। এর ফলে ভেতর থেকে তা অন্তসারশূন্য হলেও দৃশ্যত নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করা যাবে। ভাষ্যকাররা বলছেন, এবারের পরিকল্পনা-কৌশলের অংশ হিসেবে একদিকে বিরোধীজোটের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক চাপের মধ্যে রাখা হবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে কারাবন্দী রেখে তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলা হবে। নেতা-কর্মীদেরকেও অবিরাম থানা-হাজত-আদালত-জামিনের চক্করে কাটাতে হবে। অন্যদিকে তাদের সভা-সমাবেশগুলো ইতোমধ্যে অত্যন্ত সীমিত ও সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। নির্বাচনের সময় যতো ঘনিয়ে আসবে ততই এই দমন-পীড়নমূলক তৎপরতা জোরদার হবে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী প্রভৃতি সিটির নির্বাচনে এই প্রক্রিয়া সফলভাবে প্রয়োগ করা হয় বলে ভাষ্যকাররা উল্লেখ করেন।

দেশী-বিদেশী মহলের দাবি : বিগত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনসমূহের অভিজ্ঞতার আলোকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কীভাবে অংশগ্রহণমূলক করার পাশাপাশি সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং যথার্থ অর্থে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় সেই দাবী উচ্চকিত হয়ে চলেছে। গত সোমবার বাংলাদেশ সফরকালে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন মুখ্য উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিস ওয়েলস পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হকের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, নির্বাচনটি এমন হতে হবে যাতে দেশের জনগণের আকাঙ্খার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে। মার্কিন মন্ত্রী বলেন, ‘তার দেশ প্রত্যাশা করে, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এতে সব দল অংশ নেবে।’ একই দিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, তার দেশ বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। এ সময় তিনি আগামী নির্বাচনে সব দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ারও আহ্বান জানান। এর আগে গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং আরো কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের সাথে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় আনা এবং জনগণের সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। তারা বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এসময় জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) সংক্রান্ত কার্যকরী গ্রুপ বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এসময় সুইজারল্যান্ড বাংরাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করার ওপর গুরুত্ব দেয়। এছাড়া গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অবাধে অংশগ্রহণ চান বাংলাদেশের শীর্ষ কূটনৈতিক অংশীদাররা। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, সব মতাদর্শের ব্যক্তির দমন-পীড়নের ভীতি ছাড়াই মুক্তভাবে রাজনৈতিক অভিমত ব্যক্ত করা, দেশব্যাপী প্রচারণা চালানো, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ-মিছিলে যোগ দেয়ার অধিকার অবশ্যই থাকতে হবে। তিনি বলেন, দলগুলোকে অবশ্যই বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বৈধ অংশগ্রহণকারী এবং পরবর্তী সরকারের সম্ভাব্য নেতা হিসাবে মেনে নিতে হবে। একই অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিশ্বাস করেন। আর সহিষ্ণু রাজনীতি দেশের সবার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস নির্বাচনী প্রচারণাবিষয়ক একটি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে তাঁরা এসব কথা বলেন।

অপরদিকে, বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের বৃহৎ জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দাবী-দাওয়া এরই মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। ফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন গত সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে কিভাবে একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনগণের আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সে বিষয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জানান, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার নিশ্চয়তার জন্য জনগণের মধ্যে ঐক্যমত হয়ে আছে। দেশের জনগণ এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায়, যে নির্বাচনে তারা ভয়ভীতি ও প্রভাব ছাড়া তাদরে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবেন। জনগণের এই উদ্বেগ ও আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ব্যাপক-ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সাতটি দাবির ব্যাপারে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে, বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া, মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় নির্বাহী বিভাগ বা সরকার গঠন, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়া, বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করা, জনগণের আস্থা আছে এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা।
সিটি নির্বাচন কৌশলে সরকারের আস্থা : নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিরোধীদের দাবী-দাওয়ার বিপরীতে সরকার গত কয়েকমাস পূর্বে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের কৌশলকেই আশ্রয় করতে চাচ্ছে। এসব নির্বাচনে সরকারি মহলের অন্যতম কৌশল ছিলো, বিএনপি নেতাকর্মীদের কেন্দ্রমুখী হতে না দেয়া। এতে ভোটার উপস্থিতি যথাসম্ভব কম রাখা হয় এবং পুরো সিটিতে অনিয়ম না করে সুনির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্র বেছে নেয়া হয়। বিএনপির ভোট ব্যাংককে টার্গেট করা হয়। যেসব কেন্দ্রে বিএনপির ভোট অনেক বেশি সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অন্য কাউকে দাঁড়াতে দেয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকদের পুলিশ দিয়ে মাঠছাড়া করা হয়। ভোটের আগে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতারে পুলিশের অঘোষিত অভিযান চালানো হয়। নগরীতে প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে টানা গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে নির্বাচনের মাঠ অসমতল করে ফেলা হয়। এরফলে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পুলিশের গ্রেফতার অভিযান শুরুর পর কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে প্রচারাভিযান আর এগিয়ে যেতে পারেনি। এর প্রতিকারে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কিছুই করেনি। ইসি নিষ্ক্রিয় থাকায় শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হতে হয়। দল বেঁধে বুথে ঢুকে ব্যালটে সিল মারা হয় এবং জাল ভোট দেয়া হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকারি দলের কর্মীরা ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে। স্বল্প সময়ে এভাবে কিছু ভোট দিয়ে তারা সটকে পড়ে এবং সুযোগ বুঝে আবার ফিরে আসে। তারা ফিরে যাওয়ার পরপর শৃঙ্খলা রক্ষার নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হয়। ততক্ষণে সাধারণ ভোটার আতঙ্কিত হয়ে কেন্দ্র ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। সরকারদলীয় প্রার্থীর প্রতিপক্ষের এজেন্টদেরকে বুথ থেকে বের করে দেয়া হয়। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের আগের রাতে এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে আসায় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ে। প্রায় সব কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জটলা করে তারা কার্যত কেন্দ্রের প্রবেশমুখ নিয়ন্ত্রণ করে। ভোটার বা পর্যবেক্ষক যে-ই আসুন, তারা নজরদারি করে। অনেক কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা সেখানে প্রথম বাধা পান। অনেকে শারীরিকভাবে আঘাত বা অপমান-অপদস্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে যান। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ধানের শীষের ব্যাজ পরে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্ট সেজে নৌকার ভোট পাহারা দেয়ার মহড়াও চলে। কোন কোন কেন্দ্রে ভোটারদের প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারতে বাধ্য করা হয়। বাবার সঙ্গে শিশুর ভোট দেয়ার মতো অস্বাভাবিক ঘটনাও ঘটে। সবচেয়ে কমন ডায়ালগ ছিলো, ‘আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যান।’ অনেকে ভোট দিতে এসে হতাশ হয়ে কেন্দ্র থেকে ফেরত যান। সিল মারা ব্যালট বিভিন্ন কেন্দ্রে পড়ে থাকতেও দেখা যায়। যা পরে সংবাদকর্মীরা ক্যামেরায় ধারণ করেন। কেন্দ্রের বাইরে দীর্ঘ লাইন, অথচ ভেতরে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। দুপুরের আগেই ব্যালট শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। জাল ভোটের রীতিমতো উৎসব চলে। কেউ বাধা দেয়া দূরে থাক- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহায়ক ভূমিকায় থাকার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এক ধরণের ভীতিকর পরিস্থিতিতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের সামনে ভয় ছিলো দুর্বৃত্তদের গুন্ডামি এবং অন্যদিকে চাকুরি রক্ষা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুমকি। কোন কোন কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরিহিত ভোটার ছাড়া অন্য কোনো ভোটারকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। গায়ে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগানো থাকলে তাদের জন্য সর্বত্র অবাধ চলাচলের সুযোগ রাখা হয়। কোথাও কোথাও প্রিজাইডিং কর্মকর্তা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও ব্যর্থ হন। ভোটকেন্দ্রগুলো কার্যত নৌকার কর্মীদের টহল এবং নিয়ন্ত্রণে থাকে। দলবেঁধে ঢুকে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে ভোট কাটার ঘটনা ঘটে। প্রকাশ্যে কোনো দাঙ্গা হাঙ্গামা না বাধিয়ে সুকৌশলে কাজ সম্পন্ন করা হয়। ব্যালট বাক্স থেকে ব্যালট বের করে গণনার সময় দেখা যায়, কিছু ব্যালটের পেছনে সিল এবং স্বাক্ষর আছে। কিছু ব্যালটের পেছনে সিলমোহর আছে কিন্তু স্বাক্ষর নেই। আবার কিছুতে সিল-স্বাক্ষর কিছুই নেই। এর সবগুলো ব্যালটই ছিল নৌকা মার্কায় দেয়া ভোট। পরে ভোটকেন্দ্রে অবস্থানরত পুলিশের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রিজাইডিং অফিসার ব্যালটে স্বাক্ষরবিহীন ভোট ‘বৈধ’ হিসেবে গণনার নির্দেশ দেন। এরপর আর ব্যালটে স্বাক্ষর আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হয় না। সকালে ভোটারের চাপ না থাকলেও অনেক কেন্দ্রে দুপুরের আগেই অর্ধেকের বেশি ভোট সম্পন্ন হওয়ার কোন বাখ্যা কেউ দেয়নি। হানাহানি ছাড়াই গায়েবি ভোটের নয়া ‘মডেল’ চালু করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ‘ভোট ডাকাতি’র একটা নতুন সংস্করণ চালু করা হয়। পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মতে, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের রূপ হবে এমন যে- সেখানে সবকিছুই এমনভাবে সাজানো হবে- দৃশ্যত তা অংশগ্রহণমূলক বোঝাবে। কিন্তু নির্বাচনটি হবে শুধু ক্ষমতাসীন দলকে বিজয়ী করার একটি আনুষ্ঠানিকতামাত্র।

৫ জানুয়ারির অভিজ্ঞতা : একটি ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের দাবীদার আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা ছিলো বাংলাদেশের এমনকি বিগত পাকিস্তান আমলেও নজিরবিহীন। একতরফা এই নির্বাচনে ১৫৩ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি ১৪৭ জন একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ জন। ১৫৩ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ফলে ৪ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ভোটার নির্বাচনের আওতার বাইরে থেকে যান। বাকি প্রায় ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ভোটার নির্বাচনের আওতায় আসেন। এই ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ভোট প্রাপ্তির পরিমাণ দেখায় ১ কোটি ৭১ লাখ ২৯ হাজার ৮৫০ জন। যার শতকরা হার ৪০.০৪ ভাগ। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি ভোটারই এই নির্বাচনের বাইরে থেকে যান। নির্বাচনে ৪১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র ১২টি অংশগ্রহণ করে। এই নির্বাচনে এমন এমপিও হয়েছেন যারা শতকরা ২৫ ভগেরও কম ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। কয়েকজন আছেন যাদের ভোট প্রাপ্তির হার ৬.৭৫%, ৮.৯৪%, ১২.৭৫%, ১৫.৩৮%, ২০.২৯%, ২১.৩০%, ২২.২১%-এর মধ্যে সীমিত।
তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিবউদ্দীন আহমদ পরিচালিত এই নির্বাচনের এক নির্বাচনী প্রতিবেদনের মুখবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১২টি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। উত্তপ্ত ও সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে ১৪৭টি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়। তথাপি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালার অশেষ রহমতে সকলের সহযোগিতায় ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে ১৪৭টি নির্বাচনী এলাকায় ১৮,২০৮টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও বিভিন্ন সহিংস ঘটনার কারণে মোট ৫৯৬টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়।’

এই নির্বাচন দেশী-বিদেশী সর্বমহলে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করলে এর আইনী বৈধতা অর্জন করতে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। সেখানে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ফলে সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটেনি’ বলে রিট খারিজ করে দেয়া হয়। যেকারণে এই নির্বাচন আইনী বৈধতা অর্জন করে। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের দেয়া পর্যবেক্ষণে সেই সংসদও বিপুলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও পর্যবেক্ষকরা বরাবর বলে আসছেন, বর্তমান সরকার যদি বিপুল জনপ্রিয় হয়েই থাকে এবং নিজেদের বিজয় নিশ্চিত বলে ধরে নিয়ে থাকে তাহলে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সম্পূর্ণ অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু এবিষয়ে সরকারের অনঢ় মনোভাব জনমনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েই চলেছে বলে ভাষ্যকাররা মনে করেন।

http://www.dailysangram.com/post/350609