২৪ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৯

অবশেষে একটি স্মার্ট আইডি কার্ড পেলাম

খান মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী : বার বার মনে পড়ে যায় ১৯৭৪ সালের কথা। প্রতিনিয়ত ভুলে যেতে চাই সে অতীতের স্মৃতি। ভুলতে চাইলে কি হবে নিয়তি তা মনে করিয়ে দেয়। কিছু অতীত আছে মনে হলে বেদনা দেয় আবার কিছু আছে প্রেরণা যোগায়। তাই কেউ পড়ুক বা না পড়ুক একটি বই লিখেছি ‘যে অতীত বেদনা দেয়-যে অতীত প্রেরণা যোগায়’। পদ্মা পারের জেলা শরীয়তপুরের বাসিন্দা হওয়ার দরুন দারিদ্র্যতা আর পেটের জ্বালায় এমনিতে আক্রান্ত। এর মধ্যে ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল তার আক্রমণে রাস্তা থেকে কচুগাছ উঠিয়ে লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে খেয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলাম এক অজানা পথের পথিক হিসেবে। ওই সময় লঙ্গরখানায় দীর্ঘ লাইন দিয়ে খিচুরী আনতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখেছিল হতভাগি বাসন্তী দেবী। কুকুরের সাথে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কথা বলা এখানে উদ্দেশ্য নয়। এমন পরিস্থিতিতে চুরি, ডাকাতি আর ছিনতাই অব্যাহত রেখেছিল একদল মানুষ, তাদের বড় গলায় আজ জনগণ দিশেহারা। সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা ভুলে যেতে চাই, কিন্তু ভুলতে পারি না, যখন বিদ্যুৎবিল বা গ্যাস বিল দেয়ার জন্য বৃদ্ধবয়সেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কোমর ব্যথায় ধৈর্য হারা হয়ে যাই। যদি সকল ব্যাংকেই এসব বিল নেয়ার ব্যবস্থা করা হতো অথবা যেখানে বিল গ্রহণ করে সেখানে বুথ বা কাউন্টার বৃদ্ধি করা হয় তবে জনগণের কষ্ট লাঘব হতো। জনগণ নিয়ে এতসব ভাবনা ভাবার সময় কই। জনসভা আর ঝগড়াঝাটি করেই তো সময় শেষ। এবার বহু প্রতিক্ষিত একটি স্মার্ট আইডিকার্ড পাওয়ার ঘটনা। নির্বাচন কমিশন থেকে এ স্মার্ট কার্ড বিতরণের যে ব্যবস্থা করা হয় তাহলো প্রতিটি ওয়ার্ডে কয়েকটি কম্পিউটার বসিয়ে কার্ড সংগ্রহকারীদের নিকট কার্ড বিতরণ করা। এখানে কোনো ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা বেশি আবার কোনো ওয়ার্ডে কম। অথচ তাদের প্রযুক্তি ও জনবল একই। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গী থানাধীন ৪৩নং ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ৩৩ হাজার প্রায়। এখানে একটি মাত্র কেন্দ্রে এ কার্ড বিতরণ করা হচ্ছে। এ ওয়ার্ডের সম্মানিত কাউন্সিলরের পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ‘নূর মোহাম্মদ খান একাডেমী’। এখানে প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কার্ড দেয়া হয়, অথচ স্কুলের ভেতরে মাত্র হাজারখানেক লোক লাইন ধরতে পারে, তাই সকাল ৮টা থেকে কার্ড বিতরণ শুরু হলেও ফজর নামায পড়েই মানুষ লাইনে দাঁড়ায়। স্কুলের বাইরে প্রায় আধাকিলোমিটার লম্বা লাইন। কলামিস্ট ১৮ অক্টোবর সকাল ১০টায় লাইনে দাঁড়িয়ে বিকাল ৫টায় এ সোনার হরিণটি হাতে পায়। কেনো যেন এ বিষয়ে একটু লিখতে মনে চাইলো। না, লিখার জন্য লিখা নয়, আবার চিরাচরিত বাতিকও নয়। এ জন্য লেখা যে, হতেও পারে এ লেখা দেশের কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির চোখে পড়তে পারে, তখন যদি ভাগ্যক্রমে এর কোনো প্রতিকার হয়। এ জন্য নীরবে মানুষের দোয়া পেতে পারি, আমি যে দোয়ার খুবই কাঙ্গাল। পত্রিকার পাতায় কোন বেদনাদায়ক ঘটনা দেখার পর সুপ্রিম কোর্টের কোন সম্মানিত বিচারপতি যদি নিজ উদ্যোগে এর প্রতিকার করেন আইনের ভাষায় তাকে বলা হয়, সুয়োমোটো। এমন কোন ঘটনা যে এ লেখার দরুন ঘটবে না তাতো হলফ করে বলা যায় না। ওয়াশিংটন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবে কিংবা নরেন্দ্র মোদি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন তা তারা কোনদিন কল্পনাও করেননি, কল্পনা করেননি বাংলাদেশের হাসানুল হক ইনু বা কামরুল ইসলাম সাহেবও। যাই হোক, ১০টায় লাইনে দাঁড়িয়ে সাড়ে বারোটায় স্কুলের ভেতর ঢুকার সৌভাগ্য হলো। ভেবেছিলাম, যাক বাঁচা গেল। কই না, ভেতরে যাওয়ার পর এক বিরাট লাইনে দাঁড়ালাম, এ লাইনে কেবল দেখে দেয় পূর্বের কার্ডটি বা ভোটার ঠিক আছে কিনা? এখানে হাজারো মানুষের জন্য মাত্র দুটো কম্পিউটার। যদি তথ্য পেতে তাদের সমস্যা হয় তবে পাশে আরো দুটো কম্পিউটার নিয়ে দু’জন কাজ করছেন তাদের কাছে আরো উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে, তারা সেটা খুঁজে পায়। প্রশ্ন হলো, যদি প্রথম জন না পায় তবে পাশের জনকে কার্ডটি দিয়ে দিলেই হলো। না আবার অন্য একটি লাইনে দাঁড়িয়ে আবার তিন ঘণ্টায় ওই কম্পিউটারের সামনে গেলে তারা ঠিকমতই তথ্য পেল এবং একটি নাম্বার দিল। এরপর আবার একটি লাইনে দাঁড়িয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও চোখের ছবি নেয়া হলো। এখানেই শেষ নয়, এরপর দাঁড়াতে হলো আরো একটি লাইনে। তারা কার্ডটি হস্তান্তর করবে। সাড়ে বারোটায় ভেতরে ঢুকে সাড়ে পাঁচটায় কার্ডটি পেলাম। এ ৫ ঘন্টার মধ্যে ভেতরে কোন খাবার তো দূরের কথা একটু পানিয় পান করার ব্যবস্থাও নেই। অথচ নির্বাচিত কাউন্সিলরের একটি একাডেমী এটি। ক্ষুধা ও পিপাসায় জীবন যায় যায়, যাদের ডায়াবেটিস ছিল তাদের মধ্যে কয়েকজনকে অসুস্থ হতে দেখা গিয়েছে। আমার অবস্থাও খুবই নাজুক ছিল। এরই মধ্যে এলাকার দুজন সমাজসেবক জনাব গাজী আবু হানিফ ও জনাব সিরাজুল ইসলাম কার্ড পাওয়ার সাথে সাথে আমাকে বাইরে নিয়ে একটি বন রুটি ও জিলাপী খাওয়ালেন, তখন আমি যেন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলাম। স্থানীয় কাউন্সিলর এবং পরাজিত প্রার্থীরা মনে হয় জনগণের উপর রাগ করে তাদের সেবায় এগিয়ে আসেননি। যুক্তি হলো যিনি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি মনে করছেন, তোমাদের ভোটে আমি নির্বাচিত হইনি, আর যারা পরাজিত তারা ভাবছেন আবার ৫ বছর পর নির্বাচন, এখন টাকা খরচ করে লাভ কি, আর দেশের নির্বাচনের যে অবস্থা তাতে জনগণের ভোটের কোনো প্রয়োজন নেই। টাকা দিয়ে মার্কা কিনে আনবো জনগণ গোল্লায় যাক। এই হচ্ছে বর্তমানে আমাদের মত অসহায় জনগণের অবস্থা। আজ ১৯ অক্টোবর মহিলাদের কার্ড বিতরণ করা হচ্ছে। দেখা গেল গতকালের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নারী, তারা ভোররাত থেকে রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার স্ত্রীর সহকারী সোনালীর মা বেলা সাড়ে এগারোটায় কার্ড না নিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে। ক্ষুধায় ও নাকি কাতর। তার তো আর গাজী আবু হানিফ নেই যে, তাকে রুটি জিলাপি খাওয়াবে কে? অসহায় এ নারী বললো, এ পর্যন্ত তিনজন মহিলা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কি হয় কতজন জ্ঞান হারায় তাই দেখার বিষয়। এ যদি হয় একটি দেশের অবস্থা। এ যদি হয় নাগরিক সুবিধা, এ যদি হয় জনগণের সেবা, তবে কেন ’৭৪ সালের সেবার কথা মনে হবে না। বাসন্তি দেবীদের কথা ভুলতে চাইলেই আমরা ভুলতে পারবো? কারা যেন থেকে থেকে ডেকে ডেকে আমাদের বলছে, মনে আছে তো সেই বাসন্তি দেবীর কথা, যাকে ইজ্জত সম্ভ্রম রক্ষা করতে হয়েছিল গাছের পাতা দিয়ে, আর সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়েছিল কেবল একটু খিচুরি খেতে গিয়ে।

http://www.dailysangram.com/post/350626