২৪ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৯

খোলা ময়দান আবদ্ধ মিলনায়তন বন্ধ

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : বাংলাদেশে এখন মুখ বন্ধ। কলম বা ল্যাপটপ বন্ধ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ। সরকারি দল ছাড়া আর সকল দলের সভাসমাবেশ বন্ধ। কেন বন্ধ? কারণ সরকারি দল ছাড়া আর সকল দল ‘নাশকতা’ করতে পারে। দারুণ যুক্তি। এ যুক্তি পুলিশ দেয়। পুলিশ আর পুতুল নাচের ইতিকথা একই সূত্রে গাঁথা। ফলে এসব কথা কেউ আর বিশ্বাস করে না। ইদানীং পুলিশ কিছু মামলা দায়ের করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, অমুক মাঠে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য বিএনপি ও সহযোগীরা সমবেত হয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। সংবাদপত্রের সরেজমিন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ত্রাস তো দূরের কথা সেদিন ঐ এলাকায় ঐ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। খোলা মাঠে সন্ত্রাস করার জন্য কেউ হাজির হয়নি। এমনও দেখা গেছে, পুলিশ এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজারে হাজারে মামলা করছে। এ পর্যন্ত মামলার সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। মামলায় আসামীর সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশী। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সরকারি দল যা খুশি তাই করতে পারবে। কিন্তু বিরোধী দল মাঠে দাঁড়াতেই পারবে না। সভা সমিতি তো অনেক দূরের কথা।

বিএনপি কয়েক মাস ধরে অনেক আবেদন নিবেদন করে শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি পেয়েছে। বিএনপি বা বিরোধী দলকে সভা সমাবেশ করার জন্য পুলিশের অনুমতি পেতে দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করতে হয়। অর্থাৎ দেশ আওয়ামী লীগের। তারাই রাজা। অন্যরা প্রজা। রাজা প্রজাদের কতটুকু অধিকার দিবে সেটা নির্ভর করে রাজার মর্জির উপর। কিন্তু রাজার মর্জি বড় দুর্লভ জিনিস। বিরোধী দলকে কেন সমাবেশে অনুমতি দিচ্ছেন না? কারণ তাদের সমাবেশে নাশকতার আশঙ্কা আছে। এটি পুলিশের গতানুগতিক ভাষ্য। কিন্তু বিরোধী দল যতবার সমাবেশ করেছে ততবার দেখা গেছে, কোনো নাশকতারই ঘটনাই ঘটেনি। সরকারি দলের হোমড়া চোমড়ারা বলেছেন, নাশকতার আশঙ্কা আছে বলেই বিরোধী দলকে সমাবেশ বা মানববন্ধনের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এটা গায়েবী দাবী। আমরা যদি বলি যে আওয়ামী লীগের সভায় নাশকতার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে কি আওয়ামী লীগকে সভা করার অনুমতি দেয়া হবে না? আওয়ামী লীগের সভায় নাশকতার কোনো আশঙ্কা থাকে না। তারা সভা সমাবেশ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ প্রতিপক্ষকে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছেন। কিন্তু একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সকলকেই তো সমান সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সেটা করতে দিতে রাজী নয়।
রাজনীতিতে এখন নতুন পোলারাইজেশন ঘটেছে। বিএনপি তো ছিলোই। তাদের কোনো সভা সমিতি তো করতে দেয়া হয়ইনি। সভা সমাবেশ করতে চাইলে নানা ধরনের ধুনফুন করা হয়েছে। কিন্তু এখন নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গঠিত হয়েছে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যজোট। এই জোটের অংশীদার বিএনপি, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া প্রভৃতি রাজনৈতিক দল। বি চৌধুরী কখনোই ঈমানদার রাজনীতিক হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন না। তিনি নাকি এই সরকারের পতন চান। কিন্তু তার দাবী অদ্ভূত। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কোনো যোগসূত্র থাকতে পারবে না। সেই সঙ্গে আর এক নির্লজ্জ দাবীও তিনি করেছেন। আর তা হলো বিএনপি যাতে আগামী নির্বাচনে ১৫১ আসনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে ক্ষমতায় যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা। বিএনপিকে তিনি ১৫১ আসন থেকে ঠেকাবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি ১৫১ আসন পায় এবং সরকার গঠন করে, তাহলে বোধ করি তার কোনো আপত্তি নেই। আজব রাজনীতিক। তিনি বলেছেন, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তিনি কোনো জোট করবেন না। তাহলে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ঐক্য ঐক্য ভাব করলেন কেন?

ইতিমধ্যে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা থেকে জনাব বি চৌধুরী, মেজর (অব) মান্নান ও মাহী বি চৌধুরীকে বহিষ্কার করে নতুন বিকল্প ধারা গঠিত হয়েছে। যার নেতৃত্বে আছেন, ড. নুরুল আলম ব্যাপারী। এসব ঘটনা ২/৩ দিনের। কিন্তু এই লেখা প্রস্তুত করার সময় পর্যন্ত (১৯/১০/১৮) বি চৌধুরী, মেজর (অব) মান্নান বা বি চৌধুরীর বাচাল পুত্র মাহী বি চৌধুরীর তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
বি চৌধুরীর বিকল্প ধারা একটি পারিবারিক ও নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল। অনেকেই বি চৌধুরীকে ড. কামাল হোসেনের সমপর্যায়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, বি চৌধুরী আগরতলা নন, বরং খাটের তলা। ফলে এখন তিনি শূন্য অবস্থানে আছেন। এতে সরকার নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে। ফলে বি চৌধুরী এখন আঁস্তাকুড়েতে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। ভবিষ্যতে কোনোদিন তার পক্ষে আর রাজনীতিতে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। তিনি লোভী লোক। কিন্তু লোভ সবসময় তার অনুকূলে থাকবে এমন আশা করা যায় না।

কেননা, এই বি চৌধুরীকে যখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রেসিডেন্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বি চৌধুরী দাবী করলেন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন। বেগম খালেদা জিয়া তার এই আবদার মেনে নিয়ে তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। অতঃপর প্রেসিডেন্ট। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি জিয়ার মাজার জিয়ারত অস্বীকার করলেন। তা তিনি করতেই পারেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকা-ের পরে যেসব সাংবাদিক চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গিয়েছিলেন, তাদের মনে সংশয় ছিলো যে, বি চৌধুরীর ভূমিকা কী ছিলো? যে কক্ষে জিয়াউর রহমান শহীদ হন, তার পাশের কক্ষেই বি চৌধুরী অবস্থান করছিলেন। কেউ তার খোঁজ নেয়নি। খুনীরা তার রুমে নক পর্যন্ত করেনি। এবং তিনি নাকি ভাঁজ-ভাঙা পাঞ্জাবী পায়জামা পরে সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়েছিলেন। তার যোগসূত্র নিয়ে কি প্রশ্ন করা যায়?
আমি নিজে সেদিন সাংবাদিক হিসেবে সার্কিট হাউজে হাজির হইনি। হাজির হয়েছিলেন দৈনিক বাংলায় আমার সহকর্মী মোজাম্মেল হক। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও আমি তার সহকর্মী ছিলাম। বি চৌধুরীকে নিয়ে সবসময় আমার সন্দেহ সংশয় ছিলোই। সেগুলো আগের কথা। কিন্তু বিএনপিকে ১৫১ আসন না পাওয়ানোর যে মিশন নিয়ে তিনি নেমেছেন, তা তো সবার কাছে স্পষ্ট। বিএনপি যেন জিততে না পারে। আওয়ামী লীগের জয় হোক। এমন চিন্তা যারা করে, তাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে রাখার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।

ড. কামাল হোসেনকে সামনে নিয়ে সম্প্রতি গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এতে রয়েছে ড. কামাল হোসেনের গণ ফোরাম। এই ঐক্যফ্রন্টে ২০ দলীয় জোট যেমন আছে তেমনি আছে আ স ম আবদুর রহমানের জেএসডি, মাহমুদুদর রহমান মান্নার জাতীয় ঐক্য এবং অন্যান্য দল। কিন্তু এর ফলে সরকার এতটাই ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছে যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো সভা সমাবেশই করতে দিতে চাইছে না সরকার। নিজেরা সব করবে। কিন্তু বিরোধীদের কিছুই করতে দিবে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যখন গঠিত হয় তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদন ওবায়দুল কাদের তাকে এই বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তির একটি জায়গা থাকা দরকার যেখানে তার ভোট দিবে। কিন্তু কিছুকাল পরেই কী যে হলো, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সকল নেতা ও ছাওনেতারা এক যোগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসল। মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভায় ঘোষণা করা হলো যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সভা যেখানেই হোক প্রতিহত করা হবে। সেইদিনই ময়মনসিংহে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সভা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। কিন্তু ময়মনসিংহের ডিসি সে সভা কৌশলে বন্ধ করে দিলেন। সভা, একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। তার জন্য অনুমতি দরকার। তিনটায় সভা অনুষ্ঠানের কথা। দেড়টায় অনুমতি পাওয়া গেল। তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সভা করেনি। কারণ তাদের বিবেচনায় মাত্রা দেড় ঘণ্টার নোটিশে কোনো সভা করা সম্ভব নয়।

এরপরের ঘটনা একেবারেই নির্লজ্জ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিলো, ২৩ অক্টোবর সিলেটে। কিন্তু প্রথমে পুলিশ কর্তৃপক্ষ এই অনুমতি দিলেও পরে সে অনুমতি বাতিল করে দেয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট খোলা ময়দানের পরিবর্তে মিলনায়তনের ভেতরে সমাবেশ করতে চাইলে তাতেও অনুমতি দেয়নি পুলিশ। এমনকি সমাবেশের প্রস্তুতি সভার উপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। যুক্তি কি? যুক্তি হলো এই যে, এই সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে বিএনপি। বিএনপির হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অতএব তাদের কোনো সমাবেশ করতে দেয়া হবে না।

তাহলে নির্বাচন বা গণতন্ত্র কোথায়? আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ, যারা এই সরকারের বিরুদ্ধে, তারা কেউ কোনো সভাসমাবেশ করতে পারবে না। খোলা ময়দানেও না, আবদ্ধ মিলনায়তনেও না। তার উপর আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আসছে সম্প্রচার নীতিমালা আইন। সরকার আমাদের চোখের সামনে থেকে তুলে নিচ্ছে মুক্ত আকাশ, খোলা বাতাস, মুক্ত ময়দান এমনকি আবদ্ধ মিলনায়তন। এত কিছুর পরেও জার্মান একনায়ক হিটলারের পতন হয়েছিল। জানি না, এই সরকারের কি হবে!

http://www.dailysangram.com/post/350625