২৩ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৬:৪৭

এবার প্রকল্প অনুমোদনের ঢেউ জলবায়ু তহবিলে

সরকারের শেষ সময়ে এসে জলবায়ু তহবিলের ওপর নজর পড়েছে সংসদ সদস্য ও মেয়রদের। তহবিল থেকে টাকা পেতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ওপর রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করছেন এসব জনপ্রতিনিধি। এমপি ও মেয়রদের চাপের মুখে তড়িঘড়ি প্রকল্প অনুমোদনও দিচ্ছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় জলবায়ু তহবিলের টাকায় অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প। গত ১৬ আগস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ৫৯টি প্রকল্প। জলবায়ু তহবিল গঠনের পর ওই দিনই রেকর্ডসংখ্যক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। আগামী ২৯ অক্টোবর ট্রাস্টি বোর্ডের যে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে, সেখানে আগের রেকর্ড ভাঙতে পারে। ওই সভার জন্য তৈরি করা আলোচ্যসূচিতে ১১০টি প্রকল্প রয়েছে। সেখান থেকে অন্তত ৮০টি প্রকল্প অনুমোদন পেতে পারে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। অথচ জলবায়ু তহবিল গঠনের পর প্রতিটি ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় গড়ে ৩০টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হতো। নির্বাচনের আগে সেটি দ্বিগুণ হলো।

অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক পড়েছে। নির্বাচনের আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত এই এক মাসে চারটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অন্তত শতাধিক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। যাচাই-বাছাই ছাড়া, সমীক্ষা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এডিপিতে প্রকল্প অনুমোদনের ঢেউ এবার এসে লাগল জলবায়ু তহবিলের ওপর।
কটিয়াদি-পাকুন্দিয়া নিয়ে কিশোরগঞ্জ-২ আসন গঠিত। এই আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন। গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পাকুন্দিয়া পৌরসভার বেশির ভাগ রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী। পর্যাপ্ত ড্রেন না থাকায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। পাকুন্দিয়ার পৌরসভার রাস্তাঘাট ও ড্রেন নির্মাণের জন্য নেওয়া একটি প্রকল্প জলবায়ু তহবিলের টাকায় বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’ আগামী ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় ১৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য তিনি সচিবের কাছে জোর সুপারিশ করেন। জলবায়ু তহবিল থেকে টাকা পেতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে তদবির এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক এমপি ও মেয়র মন্ত্রণালয়ে সরাসরি গিয়ে তাঁর নিজের প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য তদবির করছেন। কেউ ফোনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। কেউ কেউ চাপও প্রয়োগ করছেন। সবার একটাই দাবি, জলবায়ু তহবিল থেকে টাকা চাই। যদিও এসব প্রকল্পের বেশির ভাগের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই।

জানতে চাইলে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বছর বাজেটে জলবায়ু তহবিলের জন্য টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে। তাই প্রকল্পের সংখ্যাও কিছুটা বেশি।’ শেষ সময়ে এত প্রকল্প অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ট্রাস্টি বোর্ডে ১১ জন মন্ত্রী আছেন। বৈঠকে তাঁরা অনেক যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প অনুমোদন দেন।’
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২৯ অক্টোবরের বৈঠকটি হবে ট্রাস্টি বোর্ডের শেষ বৈঠক। তাই সবাই চায়, তার প্রকল্প অনুমোদন হোক। প্রকল্পটি অনুমোদন করাতে পারলে নির্বাচনের আগে প্রকল্পের বিপরীতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। অন্যদিকে ভোটারদেরও এলাকার উন্নয়নের কথা বলা যাবে। ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় উত্থাপনের জন্য ১১০টি প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এমন অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। এলাকার রাস্তাঘাট ও ড্রেন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌরসভা থেকে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যে প্রস্তাবে পৌর এলাকার ড্রেন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার একটি প্রকল্পে কার্বন নির্গমন কমানো ও পরিবেশ উন্নয়নে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভার জলাবদ্ধতা নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে আলাদা একটি প্রকল্প। অনেক জেলা ও পৌরসভা থেকে প্রকল্প এসেছে, যেসব জেলা ও পৌরসভায় জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো প্রভাব নেই। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, গাজীপুর, নরসিংদী, ঠাকুরগাঁও, ঝিনাইদহ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়—এসব জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের তেমন কোনো প্রভাব না থাকলেও জলবায়ু তহবিল থেকে এসব জেলার অবকাঠামো উন্নয়নে টাকা চাওয়া হয়েছে। এমন অনেক জেলা ও পৌরসভা আছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। কিন্তু তাদের প্রকল্প অনুমোদন পাচ্ছে না। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যতম ঝুঁকিতে থাকা জেলা বরগুনার বেতাগী পৌরসভার মেয়র গোলাম কবীর জলবায়ু তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত এক টাকাও পাননি। গত এক বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেও তাঁর নিজ পৌরসভার একটি প্রকল্প এ পর্যন্ত অনুমোদন করাতে পারেননি।

জানতে চাইলে গোলাম কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদবির করে আমি প্রকল্প অনুমোদন করাতে পারব না। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রকল্প অনুমোদন করাতে হবে, সেটা আমাকে দিয়ে হবে না। আমি টাকা দিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করালে সে টাকা আমি কোথা থেকে উঠাব?’ গোলাম কবীর আরো বলেন, ‘আমি পরিবেশমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে দেখা করেছি। বলেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমার এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। অথচ আমি টাকা পাই না। তখন মন্ত্রী আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। পরবর্তী সভায় আমার প্রকল্পটি উঠবে। দেখি কী হয়!’
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় যে ধরনের প্রকল্প নেওয়া উচিত, বাংলাদেশে সে ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয় খুব কম। রাস্তাঘাট নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ—এসব প্রকল্পের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার কোনো সম্পর্ক নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব জেলা মারাত্মক ঝুঁকিতে; সেসব জেলায় প্রকল্প নেওয়া উচিত। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় প্রকল্প না নিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জলবায়ু তহবিলের টাকায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়, সেসব প্রকল্পের নজরদারিতে মারাত্মক ঘাটতি রয়ে গেছে। যার ফলে এসব প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে।’ তাঁর মতে, ‘জলবায়ু তহবিলের টাকায় প্রকল্পগুলো নেওয়া উচিত বাস্তবসম্মত জলবায়ু সম্পর্কিত। কিন্তু দুঃখজনক; সে ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয় খুবই কম।’
অপ্রয়োজনীয় খাতে জলবায়ু তহবিলের টাকা যাচ্ছে স্বীকার করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘তহবিলের টাকা নেওয়া উচিত গবেষণার কাজে, সোলার প্যানেল বসাতে, বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে। কিন্তু এখন নেওয়া হচ্ছে রাস্তাঘাট ও ড্রেন নির্মাণে। এসব কাজের জন্য তো এলজিইডি আছে। আমি চেষ্টা করছি এসব পরিবর্তনের।’
জার্মান ওয়াচের তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার ২০১০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটি) গঠন করে। এই তহবিলে এ পর্যন্ত তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। কিন্তু জলবায়ু তহবিলের টাকায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বিস্তর। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তহবিল নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরিকল্পনা কমিশনও জলবায়ু তহবিল বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু তহবিল বন্ধ না করে পরবর্তী সময়ে বাজেট থেকে জলবায়ু তহবিলে টাকা দেওয়া কমিয়ে দেন অর্থমন্ত্রী।
টিআইবির জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিভাগের সিনিয়র প্রগ্রাম ম্যানেজার জাকির হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জলবায়ু তহবিলের সীমিত অর্থের যথাযথ ব্যবহার হওয়া উচিত। এ ছাড়া অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যেসব জেলা ঝুঁকিপূর্ণ সেসব জেলায় টাকা দেওয়া উচিত।’ রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল কর্তৃপক্ষের (বিসিসিটি) একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, নিয়ম অনুযায়ী এক অর্থবছরে চারবার ট্রাস্টি বোর্ডের সভা হবে। সে হিসাবে তিন মাস পর একটি বৈঠক হওয়ার কথা। বোর্ডের শেষ বৈঠকটি হয়েছিল আগস্টে। সে হিসেবে পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা নভেম্বরের মাঝামাঝি। কিন্তু ওই সময়ে দেশে নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে। তাই আগেভাগে ট্রাস্টি বোর্ডের সভা ডাকা হয়েছে। এই বোর্ডের সভাপতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রীসহ ১১ জন মন্ত্রী এই বোর্ডের সদস্য।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/10/23/694853