২৩ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৬:৪৩

চিংড়ির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা

শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের উত্তর ঝাঁপায় বাগদা চিংড়ির তিনটি ঘের রয়েছে তার। গত বছর তিনি হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন এক কেজি পরিমাপের ২৫টি চিংড়ি। এবার একই আকারের একই পরিমাণ চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। অন্যদিকে, এক কেজি পরিমাপের ৫০টি চিংড়ি গত বছর ৬০০ টাকায় বিক্রি করতে পারলেও এবার তা তাকে বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০০ টাকায়। একই এলাকার আরেক চিংড়িচাষি প্রশান্ত কুমার মন্ডল ১৫ হাজার টাকার পোনা ছেড়েছিলেন। তার আক্ষেপ, এখনো তার পোনার আসল দামই উঠছে না। এ দুই ঘের মালিকের মতোই কথাবার্তা বললেন শ্যামনগরসহ সাতক্ষীরার আরো অনেক চিংড়িচাষি। তারা বললেন, গত বছরের তুলনায় এবার চিংড়ির মূল্য আরো কমেছে। হিসাব করলে তারা বরং ক্ষতিতেই রয়েছেন। দাম কমার কারণ সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশের বাজারে বাগদা চিংড়ির চাহিদা কমেছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উৎপাদনও কম হয়েছে। যা হয়েছে তাও সব ক্ষেত্রে মানসম্মত নয়। এতে এ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এ জেলায় চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার টন। ২০১২ সালে যেখানে চিংড়ি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৪০৮ টন, সেখানে ২০১৭ সালে উৎপাদন হয়েছে ২৭ হাজার ১৪২ টন। তবে এ বছর হঠাৎ দাম পড়ে যাওয়ায় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা। এবার মৌসুমের শুরুতে তালা উপজেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাগদা চিংড়ির ঘেরে মড়ক লাগে। এতে প্রচুর চিংড়ি মারা যায়।

এ নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের চাষি মোকসেদ আলীর সঙ্গে। পাঁচটি ঘেরের এই মালিক বলেন, পোনার দাম এবং শ্রমিকের মজুরি দুটিই বেড়ে গেছে। গত বছর প্রতি হাজার পোনা কিনেছি ২৫০-৩০০ টাকায়। এ বছর তা কিনতে হয়েছে ৫০০-৭০০ টাকায়। শ্রমিকের মজুরি ছয় হাজার টাকা থেকে বেড়ে আট-নয় হাজার টাকায় উঠেছে। বিক্রয়মূল্য কমে যাওয়ায় মৌসুমের আরো দুই মাস বাকি থাকলেও সব মিলিয়ে তিনি লাভের বদলে ক্ষতির আশঙ্কাই করছেন। জাতীয় চিংড়িচাষি সমিতির সভাপতি ডা. আফতাবুজ্জামান বলেন, চিংড়ির দাম কমার পাশাপাশি উৎপাদনও কমেছে। দাম কিছুটা কমলেও শঙ্কা ছিল না; কিন্তু এ বছর উৎপাদন কমে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন অনেকে। নদীর নাব্য হ্রাস, ঘেরের পানির প্রাপ্যতায় ঘাটতি, তাপমাত্রার তারতম্য, সুস্থ-সবল পোনার অভাব প্রভৃতি কারণে এ বছর উৎপাদন কম হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিশ্ববাজারে চিংড়ির রফতানি মূল্যের ওপর স্থানীয় বাজারের মূল্য নির্ভর করে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, বিদেশে রফতানি করা চিংড়ির বেশির ভাগই বাগদা। বিশ্ববাজারে নানা কারণে মূল্য উঠানামা করে। এ কারণেই মূলত কম দাম পাচ্ছেন চাষিরা। তবে সামনের বড়দিন উপলক্ষে দাম আবার বাড়তে পারে। বিশ্ববাজারে চিংড়ি রফতানির হার উল্লেখ করে শ্যামনগর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, ২০১৫-১৬ সালে জাতীয় চিংড়ি রফতানি ছিল ৮৩ হাজার টন। ২০১৭-১৮ সালে সেটা কমে ৬৩ হাজার টনে নেমে আসে। রফতানির বিপুল ঘাটতির কারণে বাগদার ন্যায্যমূল্য কমে যাচ্ছে। রফতানি ঘাটতির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ইউরোপসহ অন্যান্য দেশগুলোতে বর্তমানে ‘ভেনামি’ জাতের একটি চিংড়ি রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশের বাগদার তুলনায় এর স্বাদ কম হলেও দাম বেশ কম। বিদেশিরা এখন ভেনামির দিকে ঝুঁকছেন। চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকেও এটি রফতানি হচ্ছে।

এদিকে বাগদা চিংড়িতে ভাইরাস আক্রমণের পাশাপাশি রফতানি ও মূল্য কমে যাওয়ায় সাতক্ষীরার চিংড়িচাষিদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কাঁকড়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলায় ১১ হাজার ৫২২টি রেজিস্ট্রেশনকৃত ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার চাষি ১০ হাজার হেক্টর জমিতে এবার গলদা চিংড়ি চাষ করেছেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়ার চাহিদার কারণে সরকার পরিকল্পিতভাবে কাঁকড়া শিল্প গড়ে তুলেছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সাতক্ষীরায় এ শিল্পটি চাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়াতে লাভ বেশি হওয়ায় তারা বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ শুরু করেছেন। তবে গত দু’বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রচুর কাঁকড়া মারা যাওয়ায় কাঁকড়া তাদের অনেকেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে চিংড়ির মৌসুম না। বাজারেও এর পরিমাণ খুবই কম। মার্চের পর থেকে চিংড়ি বেশি করে বাজারে দেখা যাবে। ইউরোপে বড় মাছের চাহিদা কমে গেছে। তবে স্থানীয় বাজারে দাম কমেনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/160978