সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও অঙ্গহানির ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীসহ দেশব্যাপী আন্দোলনে দিন কয়েকের জন্য সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরলেও আবারও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে সব। বিশেষজ্ঞদের মনে প্রশ্ন- এত বড় আন্দোলনে বাঙালির হুঁশ না ফিরলে আর কবে ফিরবে?
গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সরেজমিন দেখা গেছে, আগের মতোই ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর বাস চলছে। চালক ও সহকরি কেউ আইন মানছে না। অধিকাংশ গাড়ি বা চালকের কারোই বৈধ কাগজপত্র নেই। গুটি কয়েকের কাছে লাইসেন্স থাকলেও সেগুলো নবায়ন করা হয়নি। যত্রতত্র থামানো হচ্ছে বাস। নিজেদের ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠা নামা করাচ্ছে। বাসের রেষারেষিও চলছে আগের মতো। গতকালও দুই বাসের রেষারেষিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। তবে মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রীদের বেশিরভাগের মাথায় হেলমেট দেখা গেছে।
অন্যদিকে, যাত্রীরাও ফিরে গেছে আগের অবস্থায়। আইন-কানুন মানার কোন প্রয়োজন মনে করছে না পথচারীরা। সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে যাচ্ছেতাইভাবে রাস্তা পাড় হচ্ছে। ফুট ওভারব্রিজ ও জেব্রার ক্রসিং থাকলেও সেগুলোর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কাছাকাছি গাড়ি চলে আসলেও হাতের ইশারা দিয়ে কোন রকমে দৌড়ে পার হচ্ছে। একইভাবে নগরীর ফুটপাতগুলোর অবস্থাও বেহাল। নগরবাসী মনে করছেন- আন্দোলনের পরে সড়ক ও ফুটপাতে ভাসমান দোকানের সংখ্যা আরও বহুগুণ বেড়েছে। অনেক এলকায় ফুটপাত ছেড়ে মূল সড়কে দোকান বসিয়েছে ভাসমান হকাররা। কেউ আইন মেনে রাস্তায় চলতে চাইলেও হকারদের হাক-ডাকে সেটি কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মূল সড়ক ধরে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকরা।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় রমিজউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। একই পরিবহনের দুটি বাস আগে যাত্রী নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করলে তাদের একটির নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু ঘটে দিয়া খানম মীম ও আবদুল করিম রাজীবের। ওই ঘটনার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীসহ সারাদেশে আন্দোলনে নামে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। নজিরবিহীন সেই আন্দোলনে নড়চড়ে বসে সরকার। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এছাড়া এসব মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা পৃথকভাবে নানা কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাস্তবে এ সব উদ্যোগ কোন কাজে আসেনি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের কঠোরতার ঘোষণার পরে গত ৫ আগস্ট থেকে ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ৪ সেপ্টেম্বর ট্রাফিক সচেতনতা মাস ঘোষণা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বরে সচেতনতা মাসে মোট মামলা করা হয়েছে এক লাখ ৭২ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে- ফিটনেস না থাকায় ৭ হাজার ৬২৮, রুট পারমিট না থাকায় ৬ হাজার ৪৯৫, ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত ৩০ হাজার ৫৬৪, উল্টোপথে গাড়ি চালানোয় ১৩ হাজার ৮৮, মোটরসাইকেলে নানা অসংগতিতে ৬৫ হাজার ৮০৩টি মামলা হয়। এছাড়া বিভিন্ন যানবাহনে ভিডিও মামলা করা হয় ১৯ হাজার ৩০৪টি। এই এক মাসে ১৪ কোটি ১৯ লাখ ৪৭৯ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। কিন্তু অভিযান শেষে কয়েকদিনের মধ্যেই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে সড়ক।
ট্রাফিক সূত্র জানায়, গত ১ আগস্ট থেকে চলতি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত রাজধানীতে ট্রাফিক আইন লঙ্গনের দায়ে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৮০টি মামলা করা হয়। এ সময় প্রায় ২৭ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের হিসাবে, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই দুই মাসে রাজধানীসহ সারা দেশে ৫৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৭০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে আগস্টে ৩০০টি দুর্ঘটনায় ৩৬১ জনের এবং সেপ্টেম্বরে ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০৯ জনের মৃত্যু ঘটে। এই দুই মাসে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১৫ জন, যাদের সাতজন মোটরসাইকেল আরোহী।
এদিকে, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে গত ১৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই নির্দেশনায়- বাসের ভেতরে চালকের লাইসেন্স ও মোবাইল নম্বর দৃশ্যমান স্থানে লাগানো, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া বাসের দরজা বন্ধ রাখা, জেব্রাক্রসিং দৃশ্যমান করা, সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল চালু এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ ও ধ্বংসের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এছাড়া গত ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ৩০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন বিশৃঙ্খল ব্যবস্থা নেই। রাজধানীতে ২৭৯টি রুটে ২৪৬টি কোম্পানির বাস চলাচল করে। মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের এত ছোট নগরীতে এত রুট ও অনেক কোম্পানির বাস চলায় সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, সড়কের বিশৃঙ্খলা বহু পুরনো। শত উদ্যোগ নিলেও দুই-এক মাসে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা ফেরাতে আরও সময় লাগবে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনে যুক্ত ক্ষমতাসীনরা আইন প্রণয়নে যুক্ত থাকে। যার কারণে সর্বদা যাত্রী স্বার্থ ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে।