২৩ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৬:৩৭

হাত বদলেই কেজিতে চালের দাম বাড়ে ৮-১২ টাকা

ধানের বাম্পার ফলন ও চালের পর্যাপ্ত মজুদেও ভোক্তা পর্যায়ে সুফল মিলছে না * আগামী মাসের শুরুতে আমন উঠলে চালের দাম কমবে

দুই দফা হাত বদলেই প্রতি কেজিতে চালের দাম বাড়ছে ৮ থেকে ১২ টাকা। এর মধ্যে মোকাম থেকে পাইকারি বাজারে গিয়ে প্রতি কেজি চালের দাম গড়ে বেড়ে যাচ্ছে ২ থেকে ৪ টাকা। হাত বদলের কারণে চালের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ছে পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে। এ দফায় প্রতি কেজিতে দাম বাড়ছে গড়ে ৬ থেকে ৮ টাকা। ফলে ধানের বাম্পার ফলন ও চালের পর্যাপ্ত মজুদেও ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল মিলছে না।

দেশের বিভিন্ন জেলায় চালের মোকাম রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মোকাম নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শেরপুর, ঈশ্বরদী ও আশুগঞ্জে। এসব মোকামে স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকা কেজি। ওই চাল মোকাম থেকে পাইকারি বাজারে যাওয়ার পর বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকা কেজি। এই এক দফা হাত বদলে প্রতি কেজি চালের দাম বাড়ছে ৪ টাকা। একই চাল পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪২-৪৪ টাকা। এই দফায় প্রতি কেজিতে চালের দাম বাড়ছে ৬-৮ টাকা। একইভাবে নাজিরশাইল চাল মোকামে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকা দরে। এই চাল মোকাম থেকে পাইকারি বাজারে গেলে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি। এই দফায় প্রতি কেজিতে দাম বাড়ছে ৪ টাকা। একই চাল পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে গেলে বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা কেজি। এ দফায় প্রতি কেজিতে দাম বাড়ছে ১২ টাকা। এভাবে প্রায় সব ধরনের চালের দামই হাত বদলের কারণে প্রতি কেজিতে গড়ে ৮ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চালের মোকাম মেসার্স নজরুল অটোরাইস মিলের মালিক মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, চালের দাম কমছে। আমন উঠলে সামনে আরও কমতে থাকবে। তবে মোকাম থেকে রাজধানীর খুচরা দামে অনেক ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা চাইলেই কম মুনাফা করে ভোক্তা পর্যায়ে আরও কম মূল্যে চাল বিক্রি করতে পারে। বেশি মুনাফার আশায় তারা তা করছে না। এ জন্য চালের দাম কমার সঠিক সুফল ভোক্তা পাচ্ছে না। রাজধানীর পাইকারি চালের আড়ত কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মোকাম, পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম কমছে। তবে আমরা পাইকাররা যে দামে চাল বিক্রি করছি, তার চেয়ে বেশি ব্যবধানে খুচরায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার খুচরা বাজার তদারকি করলে চালের দাম আরও কমে যাবে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র দুই হাত বদলে চালের মূল্যে এত বেশি ব্যবধান হওয়া কাম্য নয়। পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে সরকারের নজরদারি বাড়লে ভোক্তা পর্যায়ে এর দাম আরও কমতে পারে।

নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শেরপুর, ঈশ্বরদী, আশুগঞ্জের চালের মোকামগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৩৬ টাকা কেজি। যা রোববার বিক্রি হয়েছে ৩২ টাকা কেজি। একইভাবে এক মাস আগে মোকামে মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা কেজি। বর্তমানে এই চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। নাজিরশাইল এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫১ টাকা কেজি, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকায়। আটাশ জাতের চাল প্রতি কেজি এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৪ টাকায়। রাজধানীর চালের সর্ববৃহৎ আড়ত বাদামতলী ও কারওয়ান বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার প্রতি কেজি স্বর্ণা চাল বিক্রি হয় ৩৬ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা কেজি। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪৪-৪৫ টাকায়। নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫৩ টাকায়। আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকা কেজি, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়।

অন্যদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার, মালিবাগ বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৪ টাকা কেজি। সেক্ষেত্রে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে এই চালের দামের ব্যবধান ৬-৮ টাকা। নাজিরশাইল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা, যা পাইকারি দামের চেয়ে ১২ টাকা বেশি। আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৩-৪৪ টাকা কেজি, যা পাইকারি দামের তুলনায় ৭-৮ টাকা বেশি। মালিবাগ বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খুচরা বিক্রেতা যুগান্তরকে বলেন, চালের দাম কমতে শুরু করেছে। এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কমেছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দামের এত বেশি ব্যবধান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারওয়ান বাজার বা বাদামতলী পাইকারি চালের আড়ত থেকে চাল আনার সময় ঘাটে ঘাটে লাইনম্যানদের টাকা দিতে হয়। এর সঙ্গে আছে গাড়ি ভাড়া। তাই সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে যায়। এ কারণে পাইকারি বাজারের চেয়ে খুচরা বাজারে দাম তুলনামূলকভাবে একটু বাড়তি থেকে যাচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে সরকারি গুদামে এখন চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আমদানি পরিস্থিতিও অনেক ভালো। তাই চালের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে যে হারে দাম কমার কথা ছিল সে হারে কমছে না। আবার মোকামে যে হারে চালের দাম কমছে সে হারে খুচরা পর্যায়ে কমছে না। এ জন্য বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। এতে ভোক্তারা আরও কমমূল্যে চাল কেনার সুফল ভোগ করতে পারবে।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য মতে, ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৪৫ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১১ লাখ ৮২ হাজার টন ও গম ২ লাখ ৬৩ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে চালের মজুদ ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার ২৩০ টন ও গম এক লাখ দুই হাজার ৩০ টন। তখন সরকারি মজুদ কম থাকার সুযোগ নিয়ে চালের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছিল অসাধু ব্যবসায়ীরা। খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে সরকারি খাদ্য মজুদের মোট পরিমাণ ১৫ লাখ টনে উন্নীত করা হবে।

এ বিষয়ে খাদ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, গত বছর মূলত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হওয়ার কারণে সরকারি মজুদ তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এ কারণে এবার আমন সংগ্রহের সময় সতর্ক ছিল সরকার। চলতি বছর আমন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ পূরণ হয়েছে। এদিকে গত ৮ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় ৩৮ টাকা কেজি দরে আট লাখ টন বোরো সিদ্ধ চাল ও এক লাখ টন আতপ চাল এবং ২৬ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন ধান (দেড় লাখ টন ধানে এক লাখ টন চাল পাওয়া যাবে) সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ করা হয়। এ সময়ে ১২ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৮ টন সিদ্ধ চাল, এক লাখ ৪৯ হাজার ৯৪২ টন আতপ চাল ও ২৪ হাজার ৪৭১ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। অর্থাৎ সর্বমোট ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৪২৬ টনের সমপরিমাণ চাল সংগৃহীত হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/103799