২৩ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৬:৩০

অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতায় বীমা খাতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : দেশের অর্থনীতির আকার অনুসারে বীমা কোম্পানি বেশি। ফলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সারাবিশ্বে বীমাখাত জনপ্রিয় হলেও ভালো নেই বাংলাদেশের বীমাখাত। অসম প্রতিযোগিতা, কমিশন বাণিজ্য, প্রতারণা ও দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ এই খাতের সেবা নেয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে যে উদ্দেশ্যে বীমাখাতের সৃষ্টি হয়েছে তা ব্যর্থ হতে চলেছে। এমতাঅবস্থায় নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে বীমা কোম্পানিগুলো। বর্তমানে বীমাখাতে চলছে এক ধরনের নৈরাজ্য। বীমা খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসছে না। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের অর্থ ব্যয় করছে কোম্পানিগুলো। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ লাখ বীমা গ্রহীতা। বীমা খাত নিয়মের মধ্যে চলছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত বেপরোয়া। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বীমা খাতে অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে এমনটি জানালেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বীমা কোম্পানির প্রধান নির্বাহীদেরও বেতন দিতে পারছে না বিভিন্ন বীমা কোম্পানি। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রায় দুই বছর বীমা কোম্পানির বিশেষ নিরীক্ষা (অডিট) বন্ধ রয়েছে। সবমিলে বিশৃঙ্খল অবস্থা বীমা খাতে বিরাজ করছে।

অর্থনীতিবিদরা জানান, দেশের অর্থনীতির আকার অনুসারে বীমা কোম্পানির সংখ্যা বেশি। বর্তমানে ৭৮টি বীমা কোম্পানি কাজ করছে। ফলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ ছাড়া এ খাতে দক্ষ জনবলের খুবই সংকট। সবকিছু মিলে এ খাত বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, নিয়ম অনুসারে সাধারণ বীমা খাতের কোম্পানিগুলো থেকে গ্রাহকরা তিন ধরনের বীমা পলিসি গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে নৌ-বীমা, অগ্নিবীমা ও মটর (গাড়ি) বীমা। ১৯৫৮ সালের বীমাবিধির ৪০ ধারায় সাধারণ বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনা অনুসারে কোম্পানিগুলো নৌ-বীমার ক্ষেত্রে মোট প্রিমিয়াম আয় থেকে প্রথম এক কোটি টাকায় ১৮ শতাংশ অর্থাৎ ১৮ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় এক কোটিতে ১৫ শতাংশ, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ এক কোটিতে ১৩ শতাংশ ব্যয় করতে পারে। এছাড়া সপ্তম এক কোটিতে ১১ শতাংশ এবং এর পরবর্তী মোট প্রিমিয়ামের জন্য ১০ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারে। অর্থাৎ নৌ-বীমায় কোনো কোম্পানির আট কোটি প্রিমিয়াম আয় হলে কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে এক কোটি আট লাখ টাকা ব্যয় করতে পারে। এ ছাড়া অগ্নি ও অন্য বীমার ক্ষেত্রে প্রথম এক কোটিতে ৩০ শতাংশ, দ্বিতীয় এক কোটিতে ২৫ শতাংশ, তৃতীয় ও চতুর্থ এক কোটিতে ২৪ শতাংশ, পঞ্চম এক কোটিতে ২৩ শতাংশ, ষষ্ঠ এক কোটিতে ২২ শতাংশ, এর পরের এক কোটি ২৫ লাখে ১৮ শতাংশ এবং এর পরবর্তী মোট প্রিমিয়ামের জন্য ১৬ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে। কিন্তু কোম্পানিগুলো আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকদের এ অর্থ আরও অধিক পরিমাণে ব্যয় করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বীমা কোম্পানিগুলো নিয়মের মধ্যে চলছে না। ফলে এ খাতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বীমা খাতের আস্থার অভাব রয়েছে। কারণ একই ব্যক্তির কাছে পলিসির জন্য সব কোম্পানির লোকেরাই যায়। কিন্তু কোনো নতুন পণ্য ডিজাইনের কোম্পানিগুলো গুরুত্ব দেয় না। এ ছাড়াও পুনঃবীমার প্রিমিয়ামের টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করা দরকার। বীমা কোম্পানিতে যে টাকা রয়েছে তার ৯৫ শতাংশের বেশি সাধারণ গ্রাহকদের। কিন্তু টাকা খরচ করার সময় এদের কথা কেউ ভাবে না। দুই বছর পরপর কোম্পানিগুলো অডিট করানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকারের কাছে আবেদন করে এই অডিট বন্ধ রাখা হয়েছে। কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র আদেশও মানছে না। ওইসব কোম্পানি মনে করে কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না।

তারা বলেন, ভারত এবং উন্নত দেশগুলোতে ব্যক্তির নামে কোম্পানির লাইসেন্স দেয়া হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তির নামে লাইসেন্স দেয়। এরপর লাইসেন্স নিয়ে একটি কোম্পানি হাজার হাজার এজেন্ট ও জনবল নিয়োগ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে ইচ্ছামতো খরচ করে। কারণ হলো কোম্পানিগুলোর হাতে বিশাল সময় থাকে। ১২ বছরের জন্য বীমা পলিসি নেয়া হলে ওই সময়ের আগে কোম্পানিগুলোকে টাকা পরিশোধ করতে হয় না। ফলে বেপরোয়াভাবে খরচ করে। কিন্তু পলিসির মেয়াদ শেষ হলে মুনাফাতো দূরের কথা কোম্পানিগুলো গ্রাহককে আসল টাকাও দিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে সাতটি কোম্পানি বাদে বাকি সবই গ্রাহকের টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
জানা গেছে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের টাকা বেপরোয়াভাবে ব্যয় করছে বীমা কোম্পানিগুলো। ২০১৬ সালে আটটি বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যয় অনুসন্ধানে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। কোম্পানিগুলো হলো- গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, এক্সপ্রেস, কনটিনেন্টাল, ফিনিক্স, প্রগতি, ফেডারেল, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ ও ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিগুলোর তিন বছরের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা করার কথা। এর মধ্যে রয়েছে কোম্পানির বিনিয়োগ, ঋণ, অগ্রিম, স্থায়ী সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ, গাড়ি, জমি ও বিল্ডিং, নগদ টাকা, ট্যাক্স ও ভ্যাট এবং চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা কী পরিমাণ বেতন-ভাতা ও অন্য সুবিধা নিয়েছেন তার তথ্য।
আইডিআরএ’র বক্তব্য হলো- কোম্পানিগুলো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০-এর ৬৩ ধারা লঙ্ঘন করছে। ১৯৫৮ সালের বীমাবিধি অনুসরণ করলেও ৪৩ ধারা যথাযথভাবে তারা মানছে না। দেশের বীমা খাতের একটি প্রভাবশালী গ্রুপ নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। আইডিআরএ’র এই বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত ওই নির্দেশনা বহাল রয়েছে।

এদিকে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১৬টি জীবন বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি আইডিআরএ চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আইনে উল্লিখিত সীমার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এছাড়া সান লাইফ ৮৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা, পদ্মা লাইফ ১৬৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, প্রগতি লাইফ ১৪৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, সানফ্লাওয়ার লাইফ ৮৬ কোটি ১৮ লাখ, মেঘনা লাইফ ৮৩ কোটি ৯৪ লাখ, ন্যাশনাল লাইফ ২১ কোটি ৩৭ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ১৫৬ কোটি ২৫ লাখ, বায়রা লাইফ ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ, সন্ধানী লাইফ ১৫৫ কোটি ৫৯ লাখ, প্রগ্রেসিভ লাইফ ৩৯ কোটি ৪৪ লাখ, হোমল্যান্ড লাইফ ৪৬ কোটি ৯৫ লাখ, প্রাইম ইসলামী লাইফ ৭১ কোটি ৭৯ লাখ, ফারইস্ট লাইফ ২০০ কোটি ৫১ লাখ, রূপালী লাইফ ৪৪ কোটি ৪০ লাখ এবং ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

জানতে চাইলে আইডিআরের এক সদস্য বলেন, বিশেষ নিরীক্ষা চালুর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই বিষয়টির সমাধান হবে। এরপর কোম্পানিগুলোয় নিরীক্ষা চালানো যাবে।
এদিকে দেশের বেশ কয়েকটি বীমা কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) অভিযোগ করেছেন যে বেশ কয়েক মাস যাবত তারা দায়িত্ব পালন করছেন বেতন-ভাতা ছাড়াই। আবার অনেক কয়েকজন এমডির বেতন একটু বেশি বকেয়া হওয়ায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বীমা খাতের ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমডিরা বেতন পরিশোধ না করার অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি পরিচালকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে খাতটিতে এক ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। এমডিদের বেতন পরিশোধ না করলেও কোম্পানির অর্থ ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছেন পরিচালকরা।
এমডিদের এ বক্তব্যের ব্যাপারে মালিকপক্ষ বলছেন, কোম্পানির প্রধান হচ্ছেন এমডি। তাদের কাজ কোম্পানিকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করা। ব্যবসা এনেই বেতন নিতে হবে তাদের।
এমডিদের বেতন না পাওয়ার বিষয়ে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) জানান, পরিচালকরা তো নিজেদের পকেট থেকে এমডিদের বেতন দেবেন না। ব্যবসা এনেই বেতন নিতে হবে এমডিদের। তারা যদি ব্যবসা আনতে ব্যর্থ হন, তাহলে টাকা আসবে কোত্থেকে।

http://www.dailysangram.com/post/350500