২১ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ১০:৫৪

রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি

সড়ক-মহাসড়ক * বর্ষা এলেই সংস্কারের তোড়জোড় * জোড়াতালি দিয়েও টেকে না বেশিদিন

দুই বছরের মাথায় ভেঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে চলতি বছর কিছু সংস্কারের কাজ হলেও অন্যান্য স্থানে ফাটলের সৃষ্টি হয়ে পিচ-পাথর উঠে যাচ্ছে। সময়মতো সেগুলো মেরামত করা না হলে কিছুদিনের মধ্যেই খানাখন্দের সৃষ্টি হবে। ৮ লেন মহাসড়কের ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর সেতুৃ পর্যন্ত অনেক স্থানেই সড়কের উপরের পিচ ঢালাই উঠে ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেরও। প্রায় এক বছর ধরে এই মহাসড়কের বহু স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে। সংস্কারের অভাবে ভঙ্গুর দশায় বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে মহাসড়কটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। ঢাকা-কক্সবাজার মহাসড়কেরও বেহাল দশা। মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্থান বহুদিন ধরেই ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় রয়েছে। এতে করে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
একই অবস্থা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সড়কের। সড়কটি নির্মাণ করা হয় ২০০৫ সালে। নির্মাণের পর আর মেরামত হয়নি। দীর্ঘ ১৩ বছর সংস্কারহীন থাকায় সড়কটি এখন প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী। টাঙ্গাইলের নাগরপুর-মির্জাপুর সড়কেরও বেহাল অবস্থা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ আর সংস্কার না হওয়ায় চরম আকার ধারণ করেছে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও রয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। এমনিভাবে সারাদেশে অসংখ্য সড়ক-মহাসড়ক রয়েছে যেগুলো সময়মতো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সময়মতো সংস্কার, মেরামত ও সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এসব সড়ক আরও বেশি টেকসই করা সম্ভব। তাতে টাকাও সাশ্রয় হতো, ভোগান্তিও কমানো যেতো।
সারাদেশে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে প্রতি বছর মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছে সরকার। সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও নির্মাণ ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়ে ১৩ হাজার ৭০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের বিপরীতে গত অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭০৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল হাসান বলেন, আর্থিক সঙ্কট থাকলে প্রয়োজনে নতুন উন্নয়ন কাজ কম করে হলেও যেসব অবকাঠামো রয়েছে সেগুলোর সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। এতে করে খরচ ভোগান্তি দুটোই কমবে।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে সওজ অধিদপ্তরের আওতাধীন সড়কের পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার। এ হিসাবে সর্বশেষ অর্থবছরে প্রতি কিলোমিটার সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ৮ লাখ টাকা (৭ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮২) ব্যয় করেছে অধিদপ্তর। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, ধারাবাহিক (পিরিয়ডিক) রক্ষণাবেক্ষণ ও জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় হয়েছে এ টাকা। এ তিন ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ।
অধিদপ্তরের ২০০৫ সালের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নির্দেশিকাতেও এর গুরুত্ব সম্পর্কে বলা আছে। নিয়ম অনুযায়ী, নির্মাণ শেষ হওয়ার পর থেকেই শুরু হবে রক্ষণাবেক্ষণ পিরিয়ড। এজন্য দেশের প্রতিটি সড়ক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বরাদ্দ থাকে। সড়ক বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রতিদিন বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শন করবেন। কোথাও সড়কের অবস্থা খারাপ দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে তা ঠিক করে দেবেন। মোটামুটি এ-ই হলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বা রুটিন মেইনটেন্যান্সের কার্যাবলী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্মাণের পর যেকোনো সময় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য ‘ডিমান্ড রেসপন্ডিং মেইনটেন্যান্স’ করতে হয়। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট (পিচ) যেদিন বানানো হবে, সেদিন থেকেই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো দরপত্রের প্রয়োজন পড়ে না। এসব মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে নগদ টাকা দেয়া হয়। বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলীরা এ অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি কিনে শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন।
তবু কেনো তা সময়মতো করা হয় না-এমন প্রশ্নের উত্তরে খোদ সড়ক বিভাগের লোকজনই বলেছেন, গাফিলতির কথা। অনেকেই মনে করেন, গাফিলতির পাশাপাশি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। যা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, গাফিলতি নয়, পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম। উদাহরণ হিসাবে তারা বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ চাহিদা ও প্রাপ্ত বরাদ্দ নিয়ে স¤প্রতি একটি তালিকা প্রকাশ করেছে সওজ অধিদপ্তরের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম)। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সালে সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রয়োজন ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা। এইচডিএমের ২০১০-১৮ সাল পর্যন্ত চাহিদা ও বরাদ্দের চিত্র বিশ্লেষণ করে প্রতি বছরই বিস্তর ফারাক দেখা গেছে।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অপ্রতুল বরাদ্দের পাশাপাশি জনবলের অভাবের কারণেই সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ না থাকায় চাহিদার সাথে ফারাক বাড়ছেই। এলজিইডি’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল হাসান বলেন, আমার মনে হয় সড়ক মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ কম থাকে। তাও আবার সেগুলো সময়মতো পাওয়া না গেলে সমস্যা হওয়ারই কথা। বিদ্যমান অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা উচিত। আর্থিক সঙ্কট থাকলে প্রয়োজনে নতুন উন্নয়ন কাজ কমিয়ে বিদ্যমান অবকাঠামোগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য বরাদ্দ দেয়া উচিত।

https://www.dailyinqilab.com/article/160647/