নির্দিষ্ট জায়গা ব্যবহার না করে ইচ্ছামতো রাস্তা পারাপার পথচারীদের। ছবিটি বনানী থেকে তোলা। ছবি : শেখ হাসান
২১ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ১০:৫২

ঢাকায় দুর্ঘটনায় নিহতদের অর্ধেকই পথচারী

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী জাদুঘরের সামনের সড়ক। নানা আতাউর রহমানের কোলে ২১ মাসের নাতি শিশু ফাহাদ। সে ঘুমাচ্ছে নানার কোলেই। দুই হাতে ভালো করে নাতিকে চেপে ধরে রাস্তা পার হওয়ার জন্য ১০ মিনিটেরও বেশি অপেক্ষায় থাকেন তিনি। খুব দ্রুতগতিতে গাড়ি চলাচল করছে। এর মধ্যে ফাঁক পাওয়া যে বড় কঠিন। নেই পারপারের কোনো সেতু। একসময় মেয়ে তানজিনা আক্তারসহ কোলের নাতি ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে রাস্তার ওপার থেকে এপারে এসে হাঁফ ছাড়েন তিনি। গতকাল শনিবার দুপুর আড়াইটায় বিমান জাদুঘরের সামনে দাঁড়ানো তানজিনা বললেন, প্রতিদিন এভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয়। পাশে দাঁড়ানো রাবিতা বেগম ঝুমি বললেন, তিনি লন্ডন থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন। কিন্তু রাস্তার অবস্থা দেখে তাঁর বেড়ানোর সাধ উবে গেছে।

গতকাল ছিল সরকারি ছুটির দিন। এদিনও মিরপুর-আগারগাঁও সড়কসহ রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে হাতে প্রাণ নিয়ে চলন্ত গাড়ির ফাঁক দিয়ে রাস্তা পারাপার হতে দেখা গেছে পথচারীদের। বড় বেশি ভয় নিয়ে শিশুদের পারপার করতে দেখা গেছে অভিভাবকদের। তবে গুলিস্তান ও গাবতলীতে পাতাল সড়ক (আন্ডারপাস) থাকলেও খুব কম পথচারীকে তা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে কারওয়ান বাজারের পাতাল সড়ক ব্যবহার করতে দেখা গেছে অপেক্ষাকৃত বেশি পথচারীকে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যানুসারে, গত বছর ঢাকায় সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই ছিল পথচারী। চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সংঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে প্রাণহানি যত হয়েছে তার প্রায় ৪০ শতাংশই পথচারী। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, জসীমউদ্দীন মোড়, বনানী, খিলক্ষেত, মহাখালী, মিরপুর—এসব এলাকায় ঘটছে বেশি দুর্ঘটনা।
দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকায় জুতসই ও উপযুক্ত ৭২টি ফুট ওভারব্রিজ আছে। এগুলোর বেশির ভাগ ব্যবহার করে না পথচারীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর কাকলীসহ বিভিন্ন স্থানে সেতু পারাপার বেড়েছিল। এরপর আবার কমে গেছে। আসলে ঢাকার পুরো সড়ক ব্যবস্থাও পথচারীবান্ধব নয়।’

সরেজমিন : গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পারাপারের সেতু না থাকায় বেশির ভাগ মোড়ে এবং সড়কের বিভিন্ন স্থান থেকে পারপার হতে পথচারীরা গাড়িচালকদের হাত তুলে ইশারা করে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রাস্তা পারাপার হতে কলেজ গেটের কাছে অপেক্ষায় থাকা সুরুজ মিয়া বললেন, ‘বড় কষ্টে, ধৈর্য ধরে রোগী নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি।’ সব সময় গাড়ি ছুটতেই থাকে। গাড়িচালক গতি কমালে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে পথচারীরা পার হয়। শেওড়ায় হেঁটে পার হওয়ার সেতু সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মাস কয়েক আগে। ফলে বিমানবন্দর সড়কের এই ব্যস্ত অংশে পথচারীরা চলন্ত গাড়ি থামিয়ে পার হয়। স্থানীয় বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, হাতে জান নিয়ে তাঁরা রাস্তা পার হন। চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে তাঁদের দৌড়াতে হয়। কুড়িল উড়াল সেতু সংলগ্ন একটি বড় ফুট ওভারব্রিজে বিমানবন্দর সড়ক পারপার হতে অনেক পথচারীকে দেখা গেছে। গত ২৯ জুলাই বাসচাপায় রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয় কুর্মিটোলায়। সেখানেও পথচারী পারপারের যথেষ্ট সুবিধা নেই। আছে জেব্রাক্রসিং। কিন্তু পথচারী ও চালকদের তা ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা লক্ষ করা যায়নি।
মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজের জন্য আগের সড়কব্যবস্থা নেই মিরপুর-১২ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। সড়কের মাঝামাঝি অংশে খুঁটি তোলা হয়েছে। সড়কদ্বীপ তুলে ফেলা হয়েছে। শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছের ফুট ওভারব্রিজ তুলে ফেলা হয়েছে। এই সড়কের এপার থেকে ওপারে চলাচলের জন্য প্রকল্প এলাকার ওপর দিয়ে সরু সরু পথ তৈরি করা হয়েছে। দেখা গেছে, গাড়িও চলছে আবার মানুষও পার হচ্ছে। আবার সড়কের বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতও নেই। কোথাও ফুটপাত দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট ও মোটরসাইকেল গ্যারেজ। মিরপুর থেকে তালতলায় গিয়ে দেখা গেল, দখলের পাশাপাশি ফুটপাতের কোনো অংশে বাগান তৈরি করে বেষ্টনী দিয়ে রাখা হয়েছে। স্থানীয় ‘দুলাল টি স্টোরের’ দোকানি লোকমান হোসেন বললেন, ‘আট বছর ধরে ফুটপাতেই ব্যবসা করছি। পুলিশকে দিনে ২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।’ দেখা গেল, তালতলায় বাসের জন্য অপেক্ষারত যাত্রীদের রাস্তার ওপরই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। চলন্ত বাস তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকেই। শেওড়াপাড়ায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের কাছে দায়িত্বরত কনস্টেবল মো. সেলিম বলেন, প্রকল্পের কাজের জন্য এখানে পুরো অংশে পথচারী ও যাত্রীদের চলন্ত গাড়ির সঙ্গেই পথ চলতে হয়। গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বর, গুদারাঘাট, বাড্ডা লিংক রোড—এ অংশেও পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হতে দেখা গেছে। গুলশান ১ নম্বরে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি চলন্ত বাসের সামনে দিয়ে পারাপার হতে গিয়ে প্রায় ধাক্কা খাচ্ছিল এস এম আলী ও কয়েকজন পথচারী। পরে চালক বাস থামিয়ে দিলে তারা রক্ষা পায়।
কাকরাইল, বিজয় সরণি, বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি, শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলা মোড়, পুরানা পল্টন, সোনারগাঁও মোড়, গুলিস্তান, শাহবাগ—সব মোড়েই দেখা গেল পথচারীরা দল বেঁধে গাড়ি থামিয়ে পারাপার হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া বিভিন্ন নির্দেশনার মধ্যে ছিল, যেসব সড়কে ফুট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে সেসব স্থানের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার হওয়া যাবে না। তবে তা মানতে দেখা যায়নি পথচারীদের। এ ছাড়া সড়কদ্বীপ যাতে সহজে পার না হওয়া যায় সে জন্য সেগুলো আরো উঁচু করার নির্দেশনাও বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল আলমের মতে, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর পুলিশ ও বিআরটিএ মামলা ও জরিমানা আদায় করছে। পথচারীদের উদ্বুদ্ধ করছে। আমি বলব, পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে।’
কমেছে হাঁটার অভ্যাস : ওয়ার্কিং ফর বেটার বাংলাদেশের (ডাব্লিউবিবি) তথ্যানুসারে, ঢাকায় যাতায়াতে ১৯ শতাংশ ট্রিপ হেঁটে, ২৮.৫ শতাংশ বাসে, ৩৮.৭ শতাংশ হয় রিকশায়। ঢাকা শহরের মোট ট্রিপের মধ্যে ৭৬ শতাংশ পাঁচ কিলোমিটারের নিচে, এর মধ্যে আবার ৫০ শতাংশ দুই কিলোমিটারের নিচে। প্রতিকূলতার কারণে আগে যেখানে ৬০ শতাংশ লোক হেঁটে চলাচল করত, এখন সে সংখ্যা ২০ শতাংশের নিচে নেমেছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/10/21/693971