ড. মাহবুব উল্লাহ্। ফাইল ছবি
২১ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ১০:৪৭

উন্নয়নের মানবিক ধারা থেকে বিচ্যুতি কাম্য নয়

ড. মাহবুব উল্লাহ্

একটি দেশের নাগরিকদের সম্পদ দু’ভাবে ভাগ করা যায়। এগুলো হল আর্থিক ও অনার্থিক সম্পদ। সম্পদের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ থেকে আয়ের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশগুলোয় নাগরিকদের আর্থিক সম্পদের অংশই বড়। একটি দেশ যত উন্নত হয়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনার্থিক সম্পদের হিস্যা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে অনুন্নত বা আধা উন্নত দেশের নাগরিকদের অনার্থিক সম্পদের হিস্যাই বড় থাকে।
সময়ের প্রবাহে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু সম্পদ বেড়েছে। ২০১৮ সালে এ দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মাথাপিছু সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৩২ ডলার। বাংলাদেশের টাকায় এর মূল্যমান ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
অনুন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার চেয়ে বস্তুগত সম্পদ অর্জনেই বেশি আগ্রহী। দেখা গেছে তাদের জমি, বাড়ি, সোনাদানার মতো সম্পদই বেশি। বস্তুগত সম্পদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে টেকসই ভোগ্যসামগ্রী।
যেমন- ইলেকট্রিক ফ্যান, টেলিভিশন, সংসারে ব্যবহার্য বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র। এ ছাড়া রয়েছে গবাদি পশু এবং কৃষিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি। অনেক সময় দেখা যায় কারও কারও অনার্থিক বা বস্তুগত সম্পদ ভালো পরিমাণেই রয়েছে। কিন্তু এসব সম্পদ থেকে সুবিধাজনকভাবে আয় সৃষ্টি করা যায় না বলে তাদের জীবনযাত্রার মান নিু পর্যায়ে থেকে যায়।
একটি পরিবারের ১৫-২০ ভরি স্বর্ণ সম্পদ থাকতে পারে। কিন্তু যে কোনো সময়ে এ সম্পদ ব্যবহার করে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না বলে এ থেকে আয়-উপার্জনও সম্ভব হয় না। ফলে এ ধরনের সম্পদকে বলা যেতে পারে এক ধরনের মৃত সম্পদ। অবশ্য যুক্তি হিসেবে বলা যায়, ভয়ানক সংকট বা বিপদের সময় সোনাদানার মতো সম্পদ বিক্রি করে আপদকালীন বিপর্যয় ঠেকা দেয়া সম্ভব।
এর চেয়ে বৃহত্তর পর্যায়ে এ ধরনের সম্পদ বাস্তবিকভাবে কোনো কাজে আসে না। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিস্তৃতি ঘটেছে। তা সত্ত্বেও ব্যাংকে আর্থিক সম্পদ গচ্ছিত রাখতে নাগরিকরা স্বস্তিবোধ করে না।
ব্যাংকিং ব্যবস্থার বেহাল দশা এবং প্রকৃত সুদের হার কম হওয়ার ফলে ব্যাংকে গচ্ছিত আর্থিক সম্পদ থেকে সন্তোষজনক আয়-উপার্জন সম্ভব- এ রকম আস্থা সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে কাজ করে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা খুবই সাধারণ ধরনের কাজকর্মে নিয়োজিত। অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত আয় বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা ব্যক্তিগতভাবে নিজস্ব ভোগের মাত্রা হ্রাস করে যা সঞ্চয় করতে পারে, সেটার ষোলোআনাই তাদের পরিবার ও পোষ্যদের জন্য রেমিটেন্স আকারে পাঠায়।
প্রাথমিকভাবে এ সম্পদের চরিত্র আর্থিক হলেও অল্প সময়ের মধ্যে এ সম্পদ অনার্থিক বা বস্তুগত সম্পদে রূপান্তরিত হয়। রেমিটেন্স উপার্জনকারী পরিবারগুলো তাদের প্রাপ্ত অর্থ আবাসন বা জমিজমা কেনার জন্যই ব্যবহার করে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জমিই হল নিরাপত্তার প্রধান উৎস।
এ ছাড়া জমি মানুষের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি করে। এ ধরনের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যারা বস্তুগত সম্পদ আহরণ করল তাদের সম্পদগত মর্যাদা বাড়ার পাশাপাশি আরেকটি প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। এ প্রক্রিয়াটি হল সম্পদ হারানোর প্রক্রিয়া।
ফলে কারও দারিদ্র্য হ্রাস পায়, আবার অন্যদের দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। আসল কথা হল, সম্পদ যেভাবেই থাকুক না কেন, তাকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের সুযোগ সীমিত থাকলে সম্পদ থেকে আয়প্রবাহ সৃষ্টি দুরূহ হয়ে পড়ে।
সুইজারল্যান্ডে বহুজাতিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুইসের ‘বৈশ্বিক সম্পদ প্রতিবেদন-২০১৮’ থেকে সম্পদ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের অবস্থা জানা গেছে। ১৮ অক্টোবর এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এটি ছিল সংস্থাটির প্রতিবেদনের নবম সংস্করণ।
এ প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ, সম্পদ বৃদ্ধির হার, মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি নারীদের সম্পদের পরিস্থিতিও উপস্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ক্রেডিট সুইসের প্রতিবেদনে হিসাব করা হয়েছে মূলত প্রাক্কলনের ভিত্তিতে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের মধ্যভাগে বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১৭ ট্রিলিয়ন (১ লাখ কোটিতে ১ টিলিয়ন) ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪.৬ শতাংশ বেশি। এ সময় প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের সংখ্যা বেড়েছে ৩.২ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় সম্পদ বৃদ্ধির হার বেশি।
ক্রেডিট সুইসের তথ্যভাণ্ডার থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭,৮০০ কোটি ডলার। ওই সময় মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ ছিল ১,১৩৮ ডলার। এর মধ্যে আর্থিক সম্পদ ৪৭০ ডলার ও অনার্থিক সম্পদ ছিল ৬৯৪ ডলার। তখন মাথাপিছু ঋণ ছিল ২৬ ডলার। ২০১৮ সালের মধ্যভাগে এসে দেশের মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ২৪,০০০ কোটি ডলারে। অর্থাৎ ২০০০ সালের তুলনায় ৩ গুণেরও বেশি।
আর এ দেশের গড় সম্পদ দাঁড়িয়েছে ২৩৩২ ডলারে। এই গড় ২০০০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে আর্থিক সম্পদ ৯২১ ডলার ও অনার্থিক সম্পদ ১,৫৩১ ডলার। ২০১৮ সালে এসেও আর্থিক ও অনার্থিক সম্পদের দূরত্ব প্রায় একই ধারায় থেকে গেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আর্থিকীকরণে (Monetization) খুব বড় ধরনের হেরফের ঘটেনি। এদিকে ভারতে মাথাপিছু সম্পদ ৭,০২৪ ডলার, পাকিস্তানে ৩,৮১৬ ডলার, মিয়ানমারে ১,৫১৫ ডলার, নেপালে ২,০৫৪ ডলার ও শ্রীলংকায় ৫,৭৫৮ ডলার। এ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান নেপাল ও মিয়ানমারের উপরে।
ক্রেডিট সুইস বাংলাদেশের মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ১০ কোটি ২৭ লাখ ৯৩ হাজার ধরে হিসাব করেছে। এ জনসংখ্যার মধ্যে ৯৭.২ শতাংশের সম্পদ ১০,০০০ ডলারের নিচে। ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের সম্পদ আছে ২.৭ শতাংশের। বাকি ০.১ শতাংশের সম্পদ ১ থেকে ১০ লাখ ডলারের মধ্যে।
জনসংখ্যার হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ২ হাজার ৭৯৩-তে। অর্থাৎ দেশের ১ লাখের বেশি মানুষের ৮৪ লাখ টাকার বেশি সম্পদ আছে। স্পষ্টতই সম্পদ বণ্টনে বিশাল বৈষম্য বিদ্যমান। এ ছাড়া এ হিসাবে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ ধরা হয়নি। পাচার হওয়া সম্পদ হিসাবের মধ্যে আনতে পারলে সম্পদ বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে দেখা দিত।
ক্রেডিট সুইস সম্পদের হিসাব করেছে আর্থিক ও অনার্থিক সম্পদের ভিত্তিতে। সম্পদের বিষয়টি এমন সংকীর্ণভাবে না দেখে যদি বস্তুগত সম্পদ, মানবিক সম্পদ, সামাজিক সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভিত্তিতে করা হতো, তাহলে চিত্রটি একেবারেই অন্যরকম হতো।
আমরা প্রীতবোধ করতে পারি যে, ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে এসে আমাদের আর্থিক ও অনার্থিক সম্পদ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ নির্মল বায়ু, সুপেয় পানি এবং সবুজ বন-বনানীর অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তা বিবেচনায় নিলে খুবই ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠত।
অবশ্য এ ধরনের সম্পদ বিবেচনায় নিয়ে হিসাব-নিকাশ অথবা প্রক্ষেপণ করা খুবই কঠিন। আর্থিক ও অনার্থিক সম্পদ সৃষ্টি করতে গিয়ে যেভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের বা প্রাকৃতিক পুঁজির ক্ষতিসাধন করা হয়েছে তার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে ভিন্ন এক চিত্র ফুটে উঠতে পারত।
সামাজিক সম্পদ বা সামাজিক পুঁজি- যার মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্য মানুষের বিবেচনাবোধ, সামাজিক সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক আস্থা ও ভালোবাসা- সেসব ক্ষেত্রেও আমাদের অবনতি দৃষ্টিগ্রাহ্য। যে কোনো সমাজের জন্য Trust বা আস্থা একটি মূল্যবান সম্পদ।
অন্য ধরনের আস্থার প্রসঙ্গ বিবেচনায় না এনেও যদি দেশের দুটি প্রধান দলের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অবস্থা বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে আমাদের সামাজিক অগ্রগতি অর্জিত তো হয়ইনি, বরং আমরা ভয়ংকরভাবে পিছু হেঁটেছি। সুতরাং উন্নয়নকে বিচার করতে হবে সর্বপ্রকার মানবিক মাপকাঠিতে। মাথাপিছু আয়ে ডলারের হিসাব আমাদের মানুষ হিসেবে অনেক দূরে ছিটকে ফেলবে। আমাদের কোনোক্রমেই উন্নয়নের মানবিক ধারা থেকে বিচ্যুত হওয়া চলবে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ্ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/102983/