রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের সকালের প্রকৃতি এখন শিশির ভেজা : নয়া দিগন্ত -
২০ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ৮:২৭

উত্তরাঞ্চলে ২ মাস আগেই নামছে শীত : তীব্র ঠাণ্ডার আশঙ্কা

দুর্ভোগের দ্বারপ্রান্তে পৌনে এক কোটি হতদরিদ্র মানুষ ; মোকাবেলায় সরকারের আগাম উদ্যোগ নেই

বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ক্রমাগত কমতে থাকা, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসায় রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবার স্বাভাবিক সময়ের দুই মাস আগেই শুরু হয়েছে শীত। সন্ধ্যার পরপরই কুয়াশার চাদরে বন্দী হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। বেড়ে গেছে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব। এই অবস্থাকে ‘ডেঞ্জার’ উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চলমান আবহাওয়ায় পরিবর্তন না এলে এবার শীতের তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতে এই অঞ্চলের পৌনে এক কোটি হতদরিদ্র মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞেরা। প্রাণহানির আশঙ্কাও করছেন তারা।
রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, কার্তিক মাসের শুরু থেকেই এই অঞ্চলে ক্রমাগতই কাছাকাছি আসছে সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। কমছে বাতসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও। এতে বাড়ছে আর্দ্রতার শতকরা হার।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সর্বোচ্চ সর্বনি¤œ তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা এবং সন্ধ্যায় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এবার দুই মাস আগেই এই অঞ্চলে শীত এসে গেছে। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এই অঞ্চলে শীত শুরু হতে দেখা যায়। কিন্তু এবার কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহেই শীত এসেছে উত্তরাঞ্চলে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী প্রকৌশলী আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ আলী নয়া দিগন্তকে জানান, এবার আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা শুরু করেছে। ফলে শীত ও কুয়াশাও পড়া শুরু হয়েছে আগে থেকেই। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ক্রমাগত কমার কারণে শীত অনুভবের পাশাপাশি আগাম কুয়াশা পড়াও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এবার এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। আবহাওয়ার এই অবস্থার উন্নতি না হলে এবার তীব্রতর শীত পড়বে। যার পদধ্বনি ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। শীতের তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করছেন এই আবহাওয়াবিদ।
সরেজমিন পাওয়া তথ্য মতে, এবার এই অঞ্চলে আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই শীত শুরু হয়েছে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকেই বাড়ছে শীতের তীব্রতা। মাগরিবের নামাজের আগেই বিস্তীর্ণ জনপদে দেখা যায় কুয়াশার চাদর। ফলে এই অঞ্চলের নগর-বন্দর, পাড়া-মহল্লার আড্ডাস্থলগুলো ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ শীতের গরম কাপড় পরে চলাফেরা শুরু করে দিয়েছেন। বাসাবাড়িতে লেপ, কাঁথা বের করা হয়েছে। ভোরেও কুয়াশার কারণে অনেক পরিবহন হেড লাইট জ্বালিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নীলফামারীর জলঢাকার কালিগঞ্জ গ্রামের কৃষক সেরেজ জামাল (৫৫) নয়া দিগন্তকে জানান, ‘এবার গত বছরের চেয়েও এক মাস আগে শীত এসেছে। এবার গরিব মানুষের খুব কষ্ট হবে।’
আগাম উদ্যোগ নেই : সরকারি হিসেবে এই অঞ্চলে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ। তাদেরকে সরকার ভিজিএফ ভিজিডিসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু এসব অতিদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় কেনার তেমন একটা সামর্থ্য থাকে না। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার দেয়া শীতবস্ত্রই তাদের ভরসা ফি বছর। অন্য দিকে সেন্টার ফর স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিএসডি) নামের একটি সংগঠন তাদের জরিপে বলেছে, উত্তরের ১৬ জেলায় সাড়ে ৮ হাজার বস্তিসহ প্রায় পৌনে এক কোটি অতিদরিদ্র মানুষের বসবাস। প্রতি বছরই শীতে তাদের অবস্থা কাহিল হয়। চরম দুর্ভোগের মুখে পড়েন তারা। দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। প্রতি বছরই এই অঞ্চলে শীতের তীব্রতায় প্রাণহানির ঘটনা দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজে স্থান পায়। এবার এই অবস্থা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বলা হলেও সরকারি ও বেসরকারিভাবে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আগাম কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসোর্স ইনস্টিটিউট-ইরি বাংলাদেশের কনসালট্যান্টে ড. এমজি নিয়োগী নয়া দিগন্তকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এবার আড়াই মাস আগেই শীত এসেছে উত্তরাঞ্চলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শীতের তীব্রতা বাড়বে বহুগুণ। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতেও পারে। এই অবস্থার স্থায়ী সমাধানে কোনো সরকারই কোনো আগাম উদ্যোগ গ্রহণ করে না। ফলে শীতের সময় জোড়াতালি দিয়ে সরকারিভাবে প্রয়োজনের চেয়ে যৎসামান্য সহযোগিতা করা হয়। তিনি বলেন, এখনই শীত মওসুমকে অগ্রাধিকার দিয়ে উত্তরাঞ্চলের জন্য সরকার পৃথক কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ না করলে এই পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব : রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও উত্তরাঞ্চলের জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে প্রকাশ, শীতের তীব্রতা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও জেলা ও উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারি কিনিক এবং লোকালয়ের হাতুড়ে ও পল্লী চিকিৎসকদের চেম্বারেও রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্তদের ৭০ শতাংশই নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং মাথা ব্যথার রোগী। তাদের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশই বৃদ্ধ ও শিশু।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: অজয় কুমার দাস নয়া দিগন্তকে জানান, শীত আগাম আসায় এই অঞ্চলে নিউমোনিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশিসহ শীতজনিত রোগের মাত্রা বাড়া শুরু হয়েছে। এমন রোগীর সংখ্যা হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/358442/