২০ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ৮:১১

বিক্রি হচ্ছে দেদার

কাগজ-কলমে নিষিদ্ধ এনার্জি ড্রিংকস : উৎপাদন বিপণন ও বিক্রি বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেই

মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইনমিশ্রিত বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংকস নেশার জগতে নীরব সংযোজন। সমাজে এর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে বহুদিন ধরেই। নিষিদ্ধ হচ্ছে-হবে করে এরই মধ্যে কেটে গেছে কয়েক বছর। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) দেশের বাজারে এনার্জি ড্রিংকের উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এর কারণ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজারে বিক্রিত এনার্জি ড্রিংকে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু নিষিদ্ধ ঘোষণার পর এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রি বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিএসটিআই। আগের মতোই এনার্জি ড্রিংকস দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। আলাপকালে বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানান, চাহিদা অনুযায়ী তাদের এনার্জি ড্রিংকস পেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এমনকি এর দামও বাড়েনি। আগের মতোই গাড়িতে করে প্রকাশ্যেই এনার্জি ড্রিংকস সরবরাহ করা হচ্ছে। ক্রেতারাও প্রকাশ্যে কিনে খাচ্ছে।
কয়েক বছর ধরেই এনার্জি ড্রিংকসে মেশানো হচ্ছে যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রা। সিলডেনাফিল সাইট্রেট নামক ভায়াগ্রার উপাদান মিশ্রিত এনার্জি ড্রিংকস তরুণদের ছাপিয়ে বয়স্কদেরকেও আসক্ত করে ফেলে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বাজারে থাকা ৪৮টি এনার্জি ড্রিংকস পরীক্ষা করে ১৮টিতে ভায়াগ্রার উপাদান পায়। এর মধ্যে ১২টিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন এবং ৪টিতে মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পান করলে মানুষের হৃদরোগসহ কিডনী, ডায়াবেটিসজনিত রোগের ঝুঁকি রয়েছে। ক্ষতিকর খাদ্য ও পানীয় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করার জন্য এগুলোকে আমেরিকার মতো ফুড এন্ড ড্রাগসের অধীনে নিয়ে আসা উচিত। সরকারের উচিত এক্ষুণি এসব ক্ষতিকর ড্রিংকস উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। এভাবে চলতে থাকলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাবে।
জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের পরীক্ষায় বাজারের বেশ কিছু এনার্জি ড্রিংকসে ক্ষতিকর মাত্রার অ্যালকোহল পাওয়া যায়। এরপর এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে এগুলোর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করার জন্য সুপারিশও করা হয়।
গত ২৯ জুলাই বিএসটিআইয়ের সভায় ‘এনার্জি ড্রিংকস’ শিরোনামে জাতীয় মান প্রণয়ন না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কার্বোনেটেড বেভারেজ ব্যতীত ‘এনার্জি ড্রিংকস’ বা অন্য কোনো নামে পণ্য উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতের কোনো সুযোগ নেই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বিএসটিআইয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরিচালক (সাবেক) আইএফএসটি, বিসিএসআইআর ও সফট ড্রিংক অ্যান্ড বেভারেজ শাখা কমিটির সভাপতি ড. মো. জহুরুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইনমিশ্রিত বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংকস নেশার জগতে নীরব সংযোজন বলেও অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। তাদের মতে, বিভিন্ন নেশাজাতদ্রব্য মাদকাসক্তরা গোপনে সেবন করলেও এনার্জি ড্রিংকের আসক্তি বাড়ছে প্রকাশ্যেই।
সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, বাজারে বিক্রিত সফট ড্রিংকসের ক্যাফেইনের মাত্রা প্রতি কেজিতে ১৪৫ এমজি থাকলেও এনার্জি ড্রিংকসে এ মাত্রা প্রতি কেজিতে ৩২০ এমজির বেশি পাওয়া গেছে। এনার্জি ড্রিংকসের নামে নেশাজাতীয় পানীয় বন্ধে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কিন্তু নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ক্ষতিকর এই পানীয় উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রি বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখনও আগের মতোই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত এই পানীয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহেরও কোনো ঘাটতি নেই। গাড়িতে করে প্রকাশ্যেই দোকানে দোকানে সরবরাহ করা হচ্ছে। সে কারণে দামও বাড়েনি।
বিক্রেতারা জানান, অ্যালকোহল থাকার কারণেই এগুলোর চাহিদা অনেক বেশি। বরং বিক্রির স্রোতে ৫/৬টি কোম্পানি বেড়ে এখন প্রায় একশ’র উপরে গিয়ে ঠেকেছে। বোতল প্রতি বেড়েছে অ্যালকোহলের মাত্রাও। বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীরাই ক্ষণিকের ফিলিংসের জন্য এনার্জি ড্রিংকস পান করে বেশি। বেশিরভাগই স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী। ভায়াগ্রা মিশ্রিত এনার্জি ড্রিংকস ও সিরাপে বাজার এখন সয়লাব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা ড. দুলালকৃষ্ণ সাহা জানান, বাজারে থাকা কমপক্ষে ৬২টি রকমের এনার্জি ড্রিংকস ও সিরাপের রাসায়নিক পরীক্ষায় ২৩টিতে ভায়াগ্রার উপাদান পাওয়া গেছে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন ও অ্যালকোহলও রয়েছে কয়েকটিতে। তিনি বলেন, আমরা এই সব এনার্জি ড্রিংকসের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বহু আগেই এগুলোর উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করার জন্য বিএসটিআইকে সুপারিশ করেছি। কিন্তু তারা এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেয় নি।
রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে এনার্জি ড্রিংকস বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই বাজারের ‘হট’ আইটেম হিসাবে দেদারছে বিক্রি হয় এনার্জি ড্রিংকস। বিশেষভাবে কয়েকটি কোম্পানীর এনার্জি ড্রিংকসের চাহিদা অনেক বেশি। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে যৌন উত্তেজক কিছু ড্রিংকস এবং সিরাপ। এগুলো পান করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শরীরে যৌন উত্তেনার সৃষ্টি হয়। জানতে চাইলে কমলাপুর রেল স্টেশনের কাছের একজন বিক্রেতা জানান, তার দোকানে সবগুলো এনার্জি ড্রিংকসই বিক্রি হয়। শ্যামপুরের একজন ক্রেতা বলেন, পাড়া মহল্লার দোকানে লায়ন সিরাপ বেশি বিক্রি হয়। বয়স্করা এটা কিনে।
লায়ন সিরাপের পুরো নাম তনু লায়ন ফ্রুট সিরাপ। তবে লায়ন শব্দটি বড় করে লেখা। এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তনু নিউট্রিশন ফুড প্রোডাকস লিমিটেড। ঠিকানা, মনসুরাবাদ, আদাবর, ঢাকা। বিএসটিআই নম্বর: এস ৫২৮। বোতলের গায়ে এর উপাদান লেখা আছে, মাল্টা, পরিশোধিত চিনি, সাইট্রিক এসিড, সোডিয়াম বেনজায়েট, অনুমোদিত খাদ্যরং এবং ফ্লেভার। অথচ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রাসায়নিক পরীক্ষায় তনু লায়ন ফ্রুট সিরাপে ১৮৮ দশমিক ২৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন ও ১২৬ দশমিক ৮০ মিলিগ্রাম সিলডেনাফিল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সিলডেনাফিল যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রার প্রধান উপাদান। লায়ন সিরাপ পান করেছেন এমন দুজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এটি পান করার পর যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি হয় ঠিকই কিন্তু কয়েকদিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। বিশেষ করে গ্যাসট্রিক ও হার্টবিট বেড়ে যায়। খাওয়ার কোনো রুচি থাকে না। মাঝে মাঝে পেট ব্যাথা করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা ড. দুলালকৃষ্ণ সাহা বলেন, ভায়াগ্রামিশ্রিত এসব সিরাপ পান করলে গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। হৃদরোগীর তাৎক্ষণিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুও হতে পারে।
বিএসটিআই সূত্র জানায়, গত বছর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে সাতটি কোম্পানির উৎপাদিত এনার্জি ড্রিংকস সংগ্রহ করে রাজধানীর তিনটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠায়।
জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও পরীক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ল্যাবরেটরির একাধিক নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল সূত্রে জানায়, পরীক্ষায় সাতটি কোম্পানির সাতটি পানীয়তে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এর নিয়মানুসারে যে কোনো পানীয়তে ক্যাফেইনের মাত্রা ২০০ পর্যন্ত স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। কিন্তু দেশের তিন ল্যাবরেটরির পরীক্ষাতেই ওই সাতটি এনার্জি ড্রিংকে ক্যাফেইনের মাত্রা ৭০০ এর কাছাকাছি পাওয়া গেছে।
জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জানান, ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় সাতটি ড্রিংকসে তিনগুণের বেশি ক্যাফেইনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে কোম্পানিগুলোর নাম প্রকাশ করতে তিনি রাজি হননি।
ওই কর্মকর্তা জানান, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেপরোয়া বাজারজাতকরণের নীতি ও সুকৌশলে নির্মিত বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব পানীয় পান করছে।
বিভিন্ন স্বাস্থ্য সাময়িকীতে উল্লেখ করা হয়েছে, অতিরিক্ত ক্যাফেইন লিভারে চর্বি জমে। হৃদপিন্ডের রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে রক্ত চলাচল ধীর করে দেয়। এছাড়া বুক ধরফরানি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, উচ্চরক্তচাপ, ঘুমের ব্যঘাত, শরীরে অ্যাড্রেনালিন নামক হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে টানটান উত্তেজনা বৃদ্ধি ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। দিনের পর দিন অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরে প্রবেশের ফলে অসুখ সারাতে ব্যবহৃত ওষুধও কাজ করে না বলে স্বাস্থ্য সাময়িকী থেকে জানা যায়।
অত্যাধিক স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় গত ৩০ বছরের অক্টোবর ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাছে এনার্জি ড্রিংক বিক্রি নিষিদ্ধের পরিকল্পনা করে যুক্তরাজ্য সরকার।

https://www.dailyinqilab.com/article/160478/