১৯ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৩৭

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

একটি বিস্ময়কর খবরের বিশ্লেষণ

ড. আর এম দেবনাথ

বস্ত্র খাতের একটি কোম্পানি সংক্রান্ত খবর গত শুক্রবার যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদক মনির হোসেন। প্রতিবেদনটির শিরোনাম : ‘বস্ত্র খাতের কোম্পানি স্টাইল ক্রাফট, দশ টাকার শেয়ারের দাম ৪ হাজার ৯শ’ টাকা’।
বিস্ময়কর খবর। বর্তমান বাজারে কোনো একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম তার ‘অভিহিত মূল্যের’ প্রায় ৫০০ গুণ- এটা অসম্ভব ব্যাপার বৈকি! খবরের ভেতরে গিয়ে দেখলাম এ ঘটনাকে অসম্ভব মনে করে এর ওপর তদন্ত চেয়েছেন অনেকে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না।
আমি যাচ্ছি ওই কোম্পানির ব্যাংক ঋণের দিকে। প্রতিবেদনটিতে দেখলাম কোম্পানিটি তার পরিশোধিত মূলধনের ২৫ গুণ বেশি নিয়েছে ব্যাংক ঋণ। এ বিষয়টি ধরেই আমি বর্তমান ব্যাংকিং সমস্যার একটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তিনি বলেছিলেন, বিদায় নেয়ার আগে পরবর্তী সরকারের জন্য একটা পরামর্শ রেখে যাবেন। অবশ্যই ব্যাংকিং খাতের ওপর।
মুহিত সাহেবের ওই সুপারিশমালায় কি ‘স্টাইল ক্রাফটের’ অবস্থা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়টি স্থান পাবে? আমি নিশ্চিত নই। তবু এ বিষয়টির গুরুত্ব আমি তুলে ধরছি। ‘স্টাইল ক্রাফটের’ ব্যাংক ঋণের ঘটনা থেকে বোঝা যায় এ কোম্পানিটি একটি ‘ওভার বরোড’ কোম্পানি।
এর ঋণের পরিমাণ মূলধনের ২৫ গুণ। এর অর্থ মালিকের যা মূলধন কোম্পানিতে বিনিয়োজিত তার ২৫ গুণ টাকা বিনিয়োজিত ব্যাংকের। এটা অসম্ভব একটা ঘটনা। প্রথম প্রশ্ন, ব্যাংক কী করে এ কোম্পানিকে এত টাকা ঋণ দিল? অবশ্য এই প্রশ্ন করে লাভ নেই।
কারণ এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতের ঋণগ্রহীতাদের বিরাটসংখ্যক ঋণগ্রহীতা কোম্পানিই ‘ওভার বরোড কোম্পানি’। অর্থাৎ তাদের যা পাওয়া উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি তারা ঋণ নিয়ে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে এ ঋণের টাকা জমিতে গেছে, অন্যত্র ‘ডাইভার্টেড’ হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে পাচার হয়েছে।

এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে এসব ঋণের বিপরীতে ‘কোলেটারেল’ থাকে খুবই কম। এর ফলে মামলা-মোকদ্দমা করে ঋণের টাকা আদায় করা যায় না।
কারণ বন্ধকী সম্পত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলে এর মালিকানা বিতর্কিত। মূল্য অতিমূল্যায়িত। অথবা জমি-জমার অবস্থান জলের তলে। ধুরন্ধর ব্যবসায়ীরা সাধারণত এমন সব বাজে সম্পত্তিই মর্টগেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়।
ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়। কারণ তারা জানে এতে কোনো ক্ষতি নেই। সম্পত্তি বিক্রি করে পুরো টাকা আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। এই হচ্ছে বর্তমান ব্যাংকিংয়ের একটা সমস্যা।
কিন্তু আজকে ‘মর্টগেজের’ ওপর অর্থাৎ ‘বন্ধকীর’ ওপর আলোচনা করতে চাই না। আজকের আলোচনা ‘অতিরিক্ত ঋণ’ দেয়ার ওপর। এই সমস্যায় এখন ভারতের ব্যাংকিং ভুগছে। প্রয়োজনের বেশি ঋণ নিয়ে ফেঁসে গেছে কোম্পানিগুলো। অথবা ব্যাংক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে ফেঁসে গেছে। ঋণের টাকা অপব্যবহৃত হয়েছে অথবা দেশান্তরিত হয়েছে। ভারতের যে সমস্যা, সেই সমস্যা আমাদেরও। ‘ঋণখেলাপি’দের সমস্যা এখানেই লুক্কায়িত।

তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে অনেকেই ঋণের টাকার অপব্যবহার করেছেন। এখন ওই ব্যবসা থেকে ‘ক্যাশ জেনারেশন’ করতে পারছেন না। অনেকেই টাকা দেশান্তরিত করে এখন তা দেশে আনতে চাইছেন না। আবার অনেকেই টাকা বিনিয়োগ করেছেন জমিতে। ওই জমির মূল্য বর্তমানে পড়ে গেছে বাজারে।
এবংবিধ কারণে তারা এখন ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। অবশ্য যারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেবেন না বলে স্থির করেছেন তাদের কথা আলাদা। এই যে ব্যাংক উদারহস্তে কিছু গ্রাহককে সমানে টাকা দিয়ে এখন বিপদে পড়েছে তাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা কী?
‘ওভার বরোড’ কোম্পানির পক্ষে টাকা ফেরত দেয়া অসম্ভব। টাকায় যদি টাকা না আসে তাহলে ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা ফেরত দেবে কী করে? এখানে দায়-দায়িত্ব সর্বাংশে বর্তায় ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের ওপর।

পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মূলধন খুবই কম। পাঁচ, দশ, পনেরো, কুড়ি, ত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘প্রাইভেট কোম্পানিগুলো’ করা। কিন্তু এরা ব্যবসা করতে চায় শত শত কোটি টাকার। শিল্প করতে চায় শত শত কোটি টাকার, ঋণপত্র খুলতে চায় শত শত কোটি টাকার। বিভিন্ন ধরনের ঋণসুবিধা চায় কোটি কোটি টাকার।
যে কোনো ব্যাংকারেরই মনে প্রশ্ন জাগা উচিত এ ব্যবসায়ীর নিজের টাকা কোথায়? অথচ এ প্রশ্নটি না করে, ‘কোলেটারেল’ না রেখে, ‘পারসোনাল গ্যারান্টি’, কর্পোরেট গ্যারান্টি ইত্যাদির বিপরীতে শত শত কোটি টাকার ঋণসুবিধা ব্যাংকার দিচ্ছে। দিয়ে এখন পড়েছে বিপদে। নিজেরা বিপদে, ব্যাংক বিপদে, অর্থনীতি বিপদে। ঋণের জন্য ‘ইক্যুইটি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝার সময় এসেছে। আশা করি অর্থমন্ত্রীর বিদায়ী সুপারিশে এ বিষয়টি থাকবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ অন্য। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে ‘লো ইক্যুইটির’ দেশে আমরা কি ব্যাংক ঋণের ওপরই নির্ভর করব, না অন্য ব্যবস্থার কথা ভাবব? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যথাযথ পরিমাণের ‘ইক্যুইটি’সম্পন্ন কোম্পানি কম। নিজেদের পুঁজি কম। থাকলেও তা দেখাতে চায় না।

এমতাবস্থায় শুধু ব্যাংকের টাকা দিয়ে ব্যবসা ও শিল্প করার ফল অবশ্যম্ভাবীভাবে হবে খারাপ। ব্যাংক টাকা দেবে। দেবে ভালো পরিমাণ পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে।
শুধুই ঋণের ওপর ভরসা করে যে উন্নয়ন তার পরিণতিই আজ আমরা ভোগ করছি। এই ‘ব্যাংকলেড গ্রোথে’র নীতি আমার মনে হয় পুনঃবিবেচিত হওয়া দরকার। গত ৪৫-৪৬ বছরে কিছু লোকের ‘ইক্যুইটি’ হয়েছে। কীভাবে হয়েছে সেই প্রশ্নে যাওয়া জরুরি নয়।
যাদের হয়েছে তারা মূলধন দেখাক। এর বিপরীতে ঋণ নিক। সবচেয়ে বড় কথা তারা ‘পাবলিক লিমিটেড’ কোম্পানি করুক। বাজার থেকে মূলধন তুলুক।
যারা ভালো ব্যবসা করে, যাদের সুনাম আছে মানুষ তাদের নাম জানে। তারা বাজারে ‘পাবলিক লিমিটেড’ কোম্পানি করে শেয়ার বিক্রি করলে মানুষ শেয়ার কিনবে। বর্তমানে ভালো শেয়ার না পেয়ে বিনিয়োগকারীরা অনেক ক্ষেত্রে বাজে শেয়ার কিনে ঠকছে।
এটা বন্ধ করার ব্যবস্থা দরকার। যারা ভালো ব্যবসা করছেন তারা বাজারে এলে লোকেরা শেয়ার কিনবে। এতে এদের ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন কমে যাবে। সুদ খরচ কমবে। ব্যাংকের সমস্যাও কমে যাবে। আরও ব্যবস্থা হতে পারে।

বর্তমানে বাজারে যেসব ভালো কোম্পানি আছে তারা ঋণপত্র বিক্রি করে বাজার থেকে ঋণ নিতে পারে। ‘ডিবেঞ্চার’ বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার প্রথা বহু পুরনো। কেন কোম্পানিগুলো এই পথে যাবে না? কেন তারা শুধু শুধু ব্যাংকের পেছনে ঘুরবে?
আর ব্যাংকই কেন বা তাদের বলবে না বাজারে যেতে? পরিষ্কার বলে দেয়া হোক এবং সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারে। যেসব প্রাইভেট কোম্পানি বড় ব্যবসা করতে চায় তাদের বাজারে যেতে হবে, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করতে হবে। ‘প্রেফারেন্স শেয়ার’ বিক্রি করে বাজার থেকে বড় বড় কোম্পানি ঋণ সংগ্রহ করতে পারে। এমনকি ‘মেয়াদি আমানত’ (টাইম ডিপোজিট) যাতে তারা নিতে পারে সেই ব্যবস্থাও কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারে।
এ ব্যবস্থা ছিল। কেন উঠে গেল জানি না। ভালো ভালো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে মেয়াদি আমানত নেয়ার অনুমতি দিলে দোষ কী? এতে তো ব্যাংকের ওপর চাপ কমে। আর এ মুহূর্তে এটাই দরকার। যথেষ্ট হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে চাপমুক্ত করা হোক। শিল্প করার জন্য দুটো ব্যাংক ছিল শিল্প ব্যাংক এবং বিএসআরএস। খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়ে এ দুটোকেই বাজার থেকে বিদায় হতে হয়েছে। তার মানে শিল্পায়নে ব্যাংক ফিন্যান্সের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো না। তারপরেও ব্যাংকগুলোকে এ পথেই চলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের যত সমস্যা তার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত। এবং এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’ যাদের ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতা সীমিত।

এমতাবস্থায় আমাদের উচিত ব্যাংকের ওপর চাপ কমানো। ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’, গঠনের দিকে মনোনিবেশ করা একান্ত জরুরি। শিল্পায়ন এবং ব্যবসার উন্নয়নের জন্য মানুষের কাছ থেকে পুঁজি/ঋণ সংগ্রহ করা দরকার। অর্থমন্ত্রীর বিদায়ী নোটে কি এসব সুপারিশ থাকবে? জানি না।
আমি মনে করি ব্যাংকগুলোর উচিত ছোট ও মাঝারিদের ঋণ বেশি বেশি দেয়া। এতে ঝুঁকি কম। দুই, চার, পাঁচ, দশ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ক্ষমতা আমাদের ব্যাংকগুলোর যে নেই তা এর মধ্যে প্রমাণিত। এমতাবস্থায় ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ীদের বাজার থেকে টাকা তোলার জন্য উৎসাহিত করা হোক।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
rmdebnath@yahoo.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/102305