ফাইল ছবি
১৮ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৩

প্রথম একশ’র মধ্যে ৭০ জনের ফল নিয়ে প্রশ্ন

‘ক’ ও ‘গ’ ইউনিটে ফেল করে ‘ঘ’ ইউনিটে রেকর্ড নম্বর নিয়ে প্রথম * পরীক্ষা বাতিল দাবিতে মশাল মিছিল, আলটিমেটাম * অনশনের দ্বিতীয় দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থী


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সমালোচনা এখনও শেষ হয়নি। এ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে অনশন করছেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়েছে কয়েকটি সংগঠন।
এবার এ ইউনিটের ফল বিশ্লেষণ করেও মিলেছে বিস্ময়কর তথ্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, এমন অসঙ্গতিপূর্ণ ফল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে দেখা যায়নি।
ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মেধা তালিকায় প্রথম ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৭০ জনেরই ফল প্রশ্নসাপেক্ষ। তারা ইর্তিপূবে অনুষ্ঠিত নিজ নিজ ইউনিটে পাস নম্বরও তুলতে পারেননি।
মেধা তালিকায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগ থেকে যে দু’জন রেকর্ড নম্বর (১০৯.৫ ও ১১৪.৩) নিয়ে প্রথম হয়েছেন তারা নিজস্ব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর ৪৮ থেকে ৫ ও ১৪ কম পেয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান মঙ্গলবার এ ইউনিটের ফল ঘোষণা করেন। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৭০ হাজার ৪৪০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮ হাজার ৪৬৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন।

এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ হাজার ৫৯৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ৯৩৬, মানবিক বিভাগের ৮ হাজার ৭০৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪ হাজার ১৬৯ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে অংশগ্রহণকারী ১৩ হাজার ১৩৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২ হাজার ৩৫৮ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন।
শতকরা হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছেন। বিজ্ঞান বিভাগের ২৪ দশমিক ৫৬ ভাগ, মানবিক বিভাগের ৪৭ দশমিক ৮৯ ভাগ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ১৭ দশমিক ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন; যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ বছরের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের রেকর্ড।
শুক্রবার ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। টানা তৃতীয়বারের মতো প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। শুক্রবার সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর আগে ৯টা ১৭ মিনিটে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়।
বেলা ১১টায় পরীক্ষা শেষ হলে যাচাই করে দেখা গেছে, সেখানে বাংলা অংশে ১৯টি, ইংরেজি অংশে ১৭টি, সাধারণ জ্ঞান অংশে ৩৬টিসহ (বাংলাদেশ বিষয়াবলী ১৬ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী ২০) মোট ৭২টি প্রশ্নের হুবহু মিল রয়েছে। এ তিন বিষয়ে মোট ১০০টি প্রশ্ন থাকে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেধা তালিকায় প্রথম ১০০ জনের অন্তত ৭০ জনই আগের নিজ ইউনিটের পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর ৪৮ পাননি।
এই একশ’ জনের বড় অংশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ ছিল না। ১০০-এর বাইরেও মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ব্যক্তিদের অনেকের ফল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগ থেকে প্রথম হয়েছেন জাহিদ হাসান আকাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গত ২০ বছরের রেকর্ড ভেঙে ১১৪ দশমিক ৩ নম্বর পেয়ে প্রথম হন তিনি। যেখানে তিনি বাংলায় ৩০ এর মধ্যে ৩০, ইংরেজিতে ৩০ এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৩ এবং সাধারণ জ্ঞানে ৬০ এর মধ্যে ৫৭ নম্বর পান।

অথচ এই শিক্ষার্থী এর আগে তার নিজস্ব অর্থাৎ ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বাংলায় ৩০ এর মধ্যে ১০ দশমিক ৮, ইংরেজিতে ৩০ এর মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৪ নম্বর পান। সেখানে তিনি সর্বমোট ১২০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৩৪ দশমিক ৩২ নম্বর পান। ফলে পাস নম্বর ৪৮ থেকে ১৪ নম্বর কম পেয়ে ফেল করেন তিনি।
এই শিক্ষার্থী ‘ঘ’ ইউনিটে যে নম্বর পেয়েছেন তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
এছাড়া সচরাচর ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারীর নম্বরের ব্যবধান ১-২ নম্বর হলেও এখানে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী প্রথম স্থান অধিকারীর থেকে প্রায় ১৬ নম্বর কম (৯৮ দশমিক ৪) পেয়েছেন।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হয়েছেন তানসিম বিন আলম। তিনি সর্বমোট ১২০ নম্বরের মধ্যে ১০৯ দশমিক ৫ নম্বর পেয়েছেন। যেখানে ৩০ এর মধ্যে বাংলায় ২৫ দশমিক ৫, ইংরেজিতে ২৮ দশমিক ৫ এবং সাধারণ জ্ঞানে ৫৫ দশমিক ৫ নম্বর পেয়েছেন তিনি।
অথচ তার নিজ অর্থাৎ ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ৪৩ (পাস নম্বর ৪৮)। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই শিক্ষার্থী চতুর্থ বিষয়সহ জিপিএ-৫ পাননি (৪ দশমিক ৫৮)।
ফল বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, এবারের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি ফলাফল নিকট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ২০১৩-১৪ সেশনে ‘ঘ’ ইউনিটে পাসের হার ছিল ১১ দশমিক ৪ ভাগ, ২০১৪-১৫ সেশনে ছিল ১৬ দশমিক ৫৫ ভাগ, ২০১৫-১৬ সেশনে ৯ দশমিক ৯১, ২০১৬-১৭ সেশনে ৯ দশমিক ৮৩ এবং ২০১৭-১৮ সেশনে ১৪ দশমিক ৩৫ ভাগ।

অথচ এ বছর তা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২১ শতাংশে, যা আগের ফলাফলের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এমনকি চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ইউনিটের ফলাফলেও দেখা গেছে এতসংখ্যক শিক্ষার্থী কোনো ইউনিটে পাস করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য : এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভিসি ও প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা শুনে আমরাও মর্মাহত হই, হতাশ হই। আমরা এ বিষয়ে খুবই কনসার্ন। ভিসি দেশের বাইরে রয়েছেন, তবুও আমরা বিষয়টি নিয়ে বসেছি, তথ্য সংগ্রহ করছি। আমরা সবার সহযোগিতা চাই।’
তবে নতুন করে পরীক্ষা গ্রহণ বা পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট জবাব দেননি তিনি। পাস করা শিক্ষার্থীদের নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা পত্রিকা ও ফেসবুক থেকে দেখেছি। অরিজিনাল যে ডকুমেন্ট আছে, তা নিয়ে কালকে বসে মিলিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করব। আমরা অরিজিনাল ডকুমেন্ট তৈরির জন্য বলে দিয়েছি। ভিসি দুই-তিন দিন পর তো আসবেন। তিনি এলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এর মধ্যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রাখি।’
জোরাল হচ্ছে পরীক্ষা বাতিলের দাবি : ফাঁস প্রশ্নে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বাতিলের দাবি ক্রমশই জোরাল হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যায় ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট।

জোটের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক ও ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা স্বীকার করেও পরীক্ষা বাতিল না করার ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত অসম্মানের। প্রশাসনের এ ধরনের নির্লজ্জ আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। যদি এ ঘটনায় পরীক্ষা বাতিল না করা হয়, তাহলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। প্রয়োজনে ভিসি ও ডিনের কার্যালয় ঘেরাও হবে।
এ সময় তিনি তিন দফা দাবি উত্থাপন করেন। এগুলো হল- ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিল, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের শাস্তি, ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়ক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের পদত্যাগ।
পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আলটিমেটাম : আজ পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এর মধ্যে পরীক্ষা বাতিল না করা হলে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে তারা।
পাশাপাশি দাবি আদায়ে আজ বেলা ১২টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করারও ঘোষণা দেয় তারা। যুগান্তরকে এসব তথ্য জানান পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন।
এ বিষয়ে পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর বলেন, বিতর্কিত পরীক্ষা বাদ দিয়ে স্বচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের সুযোগ দিতে হবে। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না।
অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনশনরত শিক্ষার্থী : পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেয়ার দাবিতে আমরণ অনশনে বসা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আখতার হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

অনশনের দ্বিতীয় দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে তাকে বেশ অসুস্থ দেখা যায়। তবে তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সেখানে অবস্থান নিয়েছেন আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী।
মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকে অনশন শুরু করার পর থেকে রাজু ভাস্কর্যেই আছেন তিনি। বুধবার বিকাল ৪টায় তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।
আখতার হোসেন বলেন, ‘ঘ’ ইউনিটে যে প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে সেটা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হবে- এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। কারণ আমরা অনেক কষ্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। সেখানে অযোগ্য এবং মেধাহীনরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করে ভর্তি হবে- তা মেনে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
পাস করাদের নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার দাবি : প্রকাশিত ফলে যারা পাস করেছেন কেবল তাদের নিয়ে নতুন করে পরীক্ষা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে সর্বস্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মঙ্গলবার এমন প্রস্তাবে সম্মত ছিলেন না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/102035