১৮ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:২৬

মানুষ যেন নিজেকেই জানে না

জীবনে জীবন থাকে, একসময় মৃত্যুও এসে যায়। আপনজনদের মৃত্যুতে আমরা দুঃখ পাই, আহত হই, ক্রন্দনও করি। এত কিছুর পরও আমরা মৃত্যুকে স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে করে থাকি। এ কারণেই বলা হয়, ‘জন্মিলে মরিতে হয় জানিবে নিশ্চয়।’ কিন্তু আত্মহত্যা? আত্মহত্যাও তো এক ধরনের মৃত্যুই, এখানেও জীবন থাকে না। তবে আত্মহত্যাকে আমরা স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করি না। কিন্তু কেন? মানুষতো আশাবাদী হবে, দুঃখ-যন্ত্রণা ও বাধা-বিপত্তিতে সংগ্রামী হবে, হবে ধৈর্যশীল। অথচ আত্মহত্যায় আশাবাদ থাকে না, থাকে হতাশা। হতাশাতো মানবিক বিষয় হতে পারে না, হতাশায় থাকে ভুল জীবনদৃষ্টি, ভ্রান্ত জীবনদর্শন।

বর্তমান সভ্যতায় ভ্রান্ত জীবন দর্শনের প্রতাপ যেন বেড়েই চলেছে। এই প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের চিত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্যে বছরে গড়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার লোক আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার এমন প্রবণতা যে কোনো দেশের জন্যই উদ্বেগজনক। এই প্রবণতা কমিয়ে আনতে দেশটিতে আত্মহত্যা রোধে একজন মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। উল্লেখ্য যে, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এক সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১০ অক্টোবর লন্ডনে জড়ো হয়েছিলেন ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ওই ঘোষণা দিলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, জ্যাকি ডোয়েল-প্রাইস আত্মহত্যা বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। থেরেসা মে আরো বলেছেন, দাতব্য সংস্থা সামারিটানস যাতে বিনামূল্যে কাউন্সিলিং দেওয়া অব্যাহত রাখতে পারে, সে জন্য সরকার ২৪ লাখ মার্কিন ডলার তহবিল সরবরাহ করবে। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্যে মানসিক বিষাদ ও চাপে থাকা এবং আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের বিনামূল্যে হটলাইনে এবং সরাসরি কাউন্সিলিং দিয়ে থাকে সামারিটানস। আমরা জানি, যুক্তরাজ্য একটি উন্নত দেশ। শিক্ষায় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা বেশ এগিয়ে। দেশটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেরও সদস্য। এক কথায় বলা চলে, বর্তমান সভ্যতায় তারা বেশ অগ্রণী এবং সভ্যতার শাসকও বটে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অনেক সমস্যা থেকেতো তারা মুক্ত। তাই প্রশ্ন জাগে, এমন একটি দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা এত প্রবল কেন ? হতাশা ও মানসিক সংকটের কারণগুলো কী? আমরা তো এখন পৃথিবীকে এবং মানষের সমাজকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করছি। তবে আমরা রাষ্ট্রগুলোকে উন্নত, অনুন্নত বা দরিদ্র- যে অভিধায়ই অভিহিত করি না কেন, সেখানে মানুষই বসবাস করে থাকেন, ফলে সমাজটা মানুষেরই। আর মানুষ মানে শরীর-মন-আত্মার অবস্থান। যে রাষ্ট্রে বা সমাজে ওই তিন বিষয়ের সুষম বিকাশের ব্যবস্থা থাকবে, সে সমাজই হবে প্রকৃত অর্থে মানুষের সমাজ। এমন সমাজে মানুষ হতাশ হবে না, আত্মহত্যাও করবে না। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে বর্তমান সভ্যতায়। ফলে মানুষের মনে-মননে, চেতনায় যে অপূর্ণতা বা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে হবে সমাজচিন্তক ও রাষ্ট্রনেতাদের। শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকৌশল ও চাতুর্য দিয়ে নাগরিকদের হতাশা দূর করা যাবে না, আত্মহত্যার প্রবণতাও ঠেকানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে মানবসত্ত্বার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দার্শনিক ভাবনার প্রয়োজন খুবই যৌক্তিক। সময়ের এই প্রয়োজনকে বিশ্বনেতারা কতটা উপলব্ধি করেন, সেটাই দেখার বিষয়।

চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি বর্তমান সভ্যতায় মানব জীবনে নানাভাবে বিপর্যয় ডেকে আনছে। আমরা জানি, সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য অর্থ-সম্পদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রান্তিকতামুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ জীবনদর্শন। এই বিষয়টিকে মৌখিকভাবে অনেকেই স্বীকার করেন বটে, তবে আচার-আচরণে তার প্রতিফলন কমই ঘটে। অনেক সময় মনে হয় মানুষ যেন নিজেকেই জানে না। জানলে শরীর-মন-আত্মার সুসমঞ্জস্য বিকাশের বদলে মানুষ জৈবিক তুষ্টিকে এতো বেশি গুরুত্ব দেয় কেমন করে? যে কোনোভাবে সম্পদ অর্জন ও প্রদর্শনকে এত মহীয়ান করে তোলে কোন বিবেচনায়?
বর্তমান পৃথিবীতে বিচিত্র কাণ্ড ঘটে চলেছে। ফলে বিস্ময়ের শেষ নেই। ভাবা যায়, এক জোড়া জুতার দাম ১৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা! (ট্যাগে লেখা এক কোটি সত্তর লাখ ডলার)। অবশ্য এই জুতা জোড়া রত্নখচিত। দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফার শীর্ষ তলায় একটি কাঁচের বাক্সে ওই জুতা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সোনালী রঙের চামড়ায় তৈরি জুতায় সাদা রঙের স্বর্ণের ওপর শতাধিক ক্যারেটের নিখুঁত হীরা বসানো হয়েছে। এগুলোর মাঝে বসেছে ১৫ ক্যারেটের দুই খণ্ড হীরা। এই অতি দামি জুতার হীরা তো দীর্ঘস্থায়ী হবে, তবে চামড়ার স্থায়িত্ব তুলনামূলক কম। সে জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি ওই জুতার ক্ষেত্রে সারা জীবনের ওয়ারেন্টি দিয়েছে। অর্থাৎ জুতা জোড়া কখনো ছিঁড়ে গেলে তা পাল্টে দেয়া হবে। খবরটি পরিবেশন করেছে এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।

উল্লেখ্য যে, ৯ মাসের সময়সীমায় জুতাজোড়া তৈরি করেছে প্যাসন জুয়েলার্স। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিমানি করমচান্দানি বলেন, আমরা এখানে ওই জুতার কয়েকজন সম্ভাব্য ক্রেতা দেখেছি। আসলে দুবাই হলো মিলিওনিয়ার-বিলিওনিয়ারদের শহর। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে আমরা এ ধরনের বিভিন্ন নকশার জুতা তৈরি করবো। সেগুলো শুধু হীরার হবে না, রুচি ও নীলকান্তমনি দিয়েও আমরা জুতাগুলো সাজাবো। দামি ওই জুতার ধারণাটি এসেছে করমচান্দানির সহযোগী ২৬ বছর বয়সী ব্রিটিশ-রোমানিয়ান নাগরিক মারিয়া মাজারি থেকে। দুবাই ও লন্ডনে পড়াশোনা করা মারিয়ার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে, দুবাইয়ের বাজারে অনেক দামি কাপড় ও ব্যাগ রয়েছে, কিন্তু সে তুলনায় দামি জুতা একেবারেই নেই। সেই উপলব্ধি থেকেই তৈরি হয় এক কোটি সত্তর লাখ ডলারের ওই জুতা।

আমরা জানি, সভ্য মানুষ উলঙ্গ থাকেন না, পোশাক পরিধান করে থাকেন। পোশাকে সাজসজ্জা থাকে, শৈলী থাকে। তবে এটি মানুষের বাইরের বিষয়, মানুষের ভেতরের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম-দর্শন, রুচি-অভিরুচি, মনন, চেতনা, সৌন্দর্যবোধ- এগুলো ভেতরের বিষয়। ভেতরের এই বোধ ও চেতনা আমাদের বাইরের বিষয়গুলোকে সাজায়, রূপ দেয়। যেমন রূপ দিয়েছে ১৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে রতœখচিত একজোড়া জুতাকে। এই জুতা তো গলায় নয়, পায়েই পরা হবে। কোনো মানুষ যখন পদযুগলকে এতো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন তখন বুঝা যায় তার মাথা বেশ ফাঁকা- ধর্ম দর্শন, মানবিক বোধ কিংবা শুভ চেতনার কোনো উপাদান নেই ওই মস্তিষ্কে। নৈতিক মানসম্পন্ন কোনো মানুষ কি এতো অর্থ উপার্জন করতে পারেন, জুতার পেছনে কি এতো অর্থ অপচয় করতে পারেন? তার কি নিজ জাতি, সমাজের দুঃখী মানুষ ও পৃথিবীর প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই? যার মাথা থেকে ওই অতি দামি জুতার ধারণা এসেছে, তিনি তো কোনো অশিক্ষিত মানুষ নন, লন্ডন ও দুবাইয়ে তিনি লেখাপড়া করেছেন। প্রশ্ন জাগে, এ কেমন লেখাপড়া? সম্পদের এমন উগ্র প্রকাশকে তো মানসিক বিকৃতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আর যে শিক্ষা মানুষের মন-মস্তিষ্কে এমন বিকৃতি সৃষ্টি করে তাকে তো জাহেলিয়াত বা মুর্খতা হিসেবেই চিহ্নিত করতে হয়। এমন জাহেলিয়াতকে কি অনুমোদন করা যায়?

http://www.dailysangram.com/post/349824