১৭ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১০:০৮

ফাঁস প্রশ্নে পাসের রেকর্ড

ঘ ইউনিটের ফল বাতিল ও ডিনের পদত্যাগ দাবি * নতুন করে পরীক্ষা চেয়ে অনশনে শিক্ষার্থী * শুধু পাস করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিতেও অস্বীকৃতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রথমবর্ষ স্নাতক সম্মান শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ অবশেষে স্বীকার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এর পরও সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে পাস করেছে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থী। প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে এ পরীক্ষা বাতিল এবং ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়কারী সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের পদত্যাগ দাবি করেছেন প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা। অন্যথায় ভিসি কার্যালয় ও ডিন কার্যালয় ঘেরাওসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
এরই মধ্যে এ পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩টায় কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিসে ফল ঘোষণা করেন। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৭০ হাজার ৪৪০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮ হাজার ৪৬৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছে।
এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ হাজার ৫৯৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১ হাজার ৯৩৬, মানবিক বিভাগের আট হাজার ৭০৪ পরীক্ষার্থীর মধ্যে চার হাজার ১৬৯ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ১৩ হাজার ১৩৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে দুই হাজার ৩৫৮ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন।
সেই হিসাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী মোট শিক্ষার্থীর ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছেন। বিভাগ ভিত্তিক হিসাবে বিজ্ঞান বিভাগের ২৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মানবিক বিভাগের ৪৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ১৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন।
শুক্রবার ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। টানা তৃতীয়বারের মতো প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এদিন সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর আগে ৯টা ১৭ মিনিটে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। বেলা ১১টায় পরীক্ষা শেষ হলে যাচাই করে দেখা গেছে, সেখানে বাংলা অংশে ১৯টি, ইংরেজি অংশে ১৭টি, সাধারণ জ্ঞান অংশে ৩৬টিসহ (বাংলাদেশ বিষয়াবলি ১৬ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ২০) মোট ৭২টি প্রশ্নের (মোট ১০০ প্রশ্ন) হুবহু মিল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করলেও পরীক্ষা বাতিলে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
প্রকাশিত ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবারের ঘ ইউনিটের ভর্তি ফলাফল নিকট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ২০১৩-১৪ সেশনে ঘ ইউনিটে পাসের হার ছিল ১১ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৪-১৫ সেশনে ছিল ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০১৫-১৬ সেশনে ৯ দশমিক ৯১, ২০১৬-১৭ সেশনে ৯ দশমিক ৮৩ এবং ২০১৭-১৮ সেশনে ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অথচ এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২১ শতাংশে। যা আগের ফলের দ্বিগুণেরও বেশি।
এমনকি চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ইউনিটের ফলাফলেও দেখা গেছে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী কোনো ইউনিটে পাস করেননি। প্রশ্ন ফাঁসের প্রভাবে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন ভিসি। তিনি এটিকে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখেন।
প্রশ্নফাঁস নিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে ভিসি বলেন, তদন্ত কমিটি ডিজিটাল জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস বা ডিজিটাল জালিয়াতি যাই হোক, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার যেকোনো পর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলেও তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ক্ষেত্রে তাদের ভর্তি বাতিল করা হবে এবং আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রশ্ন ফাঁসের পরেও পরীক্ষা কেন বাতিল করা হবে না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থী এর সঙ্গে জড়িত। অল্প কয়েকজনের জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে খেলা করার সুযোগ নেই। অভিযুক্তদের বহিষ্কার করা হলে যেসব আসন শূন্য হবে সেখানে নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে কিনা- এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন তিনি।
পাস করাদের পরীক্ষা নিতেও অস্বীকৃতি : যারা পাস করেছেন, শুধু তাদের নতুন করে পরীক্ষা নেয়া যায় কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে ভিসি জানান, সেটি করার সুযোগ নেই।
পদত্যাগ প্রশ্নে নিশ্চুপ সাদেকা হালিম : সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। তার কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল- পরীক্ষার আগে যদি একজন শিক্ষার্থীও প্রশ্ন পেয়ে থাকে তাহলে তাকে প্রশ্নফাঁস বলা যাবে কিনা এবং উন্নত দেশের মতো ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করবেন কিনা? উত্তরে কোনো কথা বলেননি তিনি। পরে এর উত্তর দেন প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস বা ডিজিটাল জালিয়াতি যাই হোক না কেন প্রশাসন বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
আমরণ অনশনে ঢাবি শিক্ষার্থী : ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেয়ার দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন আইন বিভাগের তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী আখতার হোসেন। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের জিয়া হলের ওই শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মঙ্গলবার সাড়ে ১২টা থেকে অনশন শুরু করেন।
সাদেকা হালিমের পদত্যাগসহ ৩ দাবি : বিকেলে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে সাদেকা হালিমের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্র জোট। জোটের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক ও ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির ওই দাবি জানান। অন্য দুটি দাবি হচ্ছে- ভর্তি পরীক্ষা ও ঘোষিত ফল বাতিল এবং প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার।
উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের করণীয় : ভিসি বলেন, ঘ-ইউনিটে মোট আসন সংখ্যা রয়েছে এক হাজার ৬১৫টি (বিজ্ঞানে ১১৫২, বিজনেস স্টাডিজে ৪১০, মানবিকে ৫৩টি)। বিস্তারিত ফল বিশ্ববিদ্যালয়ের admission.eis.du.ac.bd ওয়েবসাইটে জানা যাবে। তাছাড়া, যেকোনো অপারেটরের মোবাইল ফোন থেকে DU GHA ?roll no? টাইপ করে ১৬৩২১ নম্বরে পাঠিয়ে ফিরতি এসএমএস-এ ফল জানা যাবে।
তিনি আরও জানান, পাসকৃত শিক্ষার্থীদের (বিজ্ঞান মেধাক্রম ৩৫০০ পর্যন্ত, মানবিক মেধাক্রম ৬০০ পর্যন্ত ও বাণিজ্য মেধাক্রম ১০০০ পর্যন্ত) আগামী ২২ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষার ওয়েবসাইটে বিস্তারিত ফরম ও বিষয় পছন্দক্রম ফরম পূরণ করতে হবে।
উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের কোটার ফরম ১৭ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবরের মধ্যে সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিস থেকে সংগ্রহ করে যথাযথভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে। ফলাফল নিরীক্ষণের জন্য নির্ধারিত ফি প্রদান সাপেক্ষে ১৭ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিসে আবেদন করা যাবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/second-edition/101879/