১৬ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৫:০৫

রাজীবের হাত বিচ্ছিন্নকারী দুই চালকেরই ভারি যানের লাইসেন্স ছিল না

দুই বাসের রেষারেষিতে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের হাত বিচ্ছিন্নের পর মৃত্যুর ঘটনায় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানির জন্য ১৪ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট।
সোমবার বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। রাজীবের মৃত্যুর ঘটনায় রোববার হাইকোর্টে জমা দেয়া কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার মৃত্যুর জন্য দায়ী বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই চালকেরই ভারি যানবাহন চালানোর লাইসেন্স ছিল না। এতে চালকদের ট্রিপভিত্তিক গণপরিবহন চালানো বাতিল করে মাসভিত্তিক বেতন দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৮ দফা সুপারিশ করেছেন কমিটি। দুর্ঘটনাস্থল, জব্দকৃত বাস, ভিকটিমের স্বজন ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন বুয়েটের সিভিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের মাঝে পড়ে কীভাবে রাজীব হাত হারিয়েছেন এবং ঐ দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনার জন্য স্বজন পরিবহনের চালককে দায়ী করা হলেও তার মৃত্যুর জন্য শমরিতা হাসপাতালের অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। সোমবার রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস বলেন, রোববার ৪৯ পৃষ্ঠার যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে সেখানে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। প্রতিবেদনে রাজীবের মৃত্যুর জন্য শমরিতা হাসপাতালের অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারেনি তারা।
গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের বাসের চাপায় তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হাসানের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ৮ মে হাইকোর্ট এক আদেশে রাজীবের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগ ওই আদেশ স্থগিত করে হাইকোর্টকে দুর্ঘটনার দায় নিরূপণে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
কমিটির ১৮ দফা সুপারিশ : অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ নেই বললেই চলে। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এআরআই) বিভাগটি বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা, বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান, কার্যকরী প্রশিক্ষণ ও এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা সীমিত সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলছে। সরকারের এই বিভাগটির উন্নয়নে জোর দেয়া উচিত।
১. বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এআরআই) বিভাগটির উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রাংশ, সফটওয়্যারসহ সম্পর্কিত বিষয়টি বৃদ্ধিতে সরকারের জোর দিতে হবে এবং এ জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
২. সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, পুলিশ, বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, নিরাপদ সড়ক চাইসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি কারিগরি টিম গড়ে তোলা এবং তাদের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। বড় দুর্ঘটনাগুলো অনুসন্ধানে এই টিম কাজ করবে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই টিম ঘটনাস্থলে চলে যাবে এবং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য ধ্বংস হওয়ার আগে তা উদ্ধার করবে।
৩. দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে সিসিটিভি বসাতে হবে। এতে শুধু দুর্ঘটনা অনুসন্ধানই নয় বরং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করবে।
৪. দুর্ঘটনাগুলোর নথিভুক্ত করা হয় না, তাই প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটলে তা নথিভুক্ত করতে হবে। এতে দুর্ঘটনার বিষয়টি নথিভুক্তকরণ এবং গবেষণায় পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ পুলিশকে অবশ্যই দুর্ঘটনার বিষয়ে নথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, অনুসন্ধান এবং সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৫. রাজধানীর বাসগুলোর ভেতর ও বাইরের অবস্থা করুণ। তা সত্ত্বেও বাসগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকাটা ভয়ঙ্কর। বাসগুলোর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত সেফটি ফিচার (সাইড লাইট, হুইপার, হেড লাইট, টায়ার, প্রবেশের দরজা এবং জানালা) খুবই নিম্নমানের। তাই কোনো বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে হলে সেটি সুন্দর রং এবং সেফটি ফিচারগুলো ঠিক আছে কিনা তা দেখতে হবে। নয়তো সেগুলোকে চলতে দেয়া যাবে না।
৬. বিআরটিসি বাসগুলো দৈনিক লিজ ভিত্তিতে ভাড়ায় চালিত হয়ে থাকে। অন্যান্য বাসের ক্ষেত্রে এমন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে।
৭. চলন্ত অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখতে হবে। বাসের দরজার কাছে কোনো যাত্রীকে দাঁড়িয়ে যেতে দেয়া যাবে না। নির্দিষ্ট বাসস্টপেজে বাস থামার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. বাস-বে বা স্টপেজগুলো সব রুটে নির্দিষ্টভাবে পরিচিত থাকবে। কর্তৃপক্ষ সেখানে যাত্রী ছাউনি তৈরি করবে। কোনো চলন্ত বাস ব্যস্ত সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করতে পারবে না। ট্রাফিক পুলিশকে নিয়মগুলো কঠিনভাবে মেনে চলতে হবে।

৯. বিআরটিএ বাধ্যতামূলক একটি ড্রাইভিং স্কুল থাকতে হবে, যেখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইতে হবে। এই স্কুলের সার্টিফিকেট ছাড়া কাউকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স টেস্ট করার জন্য আনা হবে না।
১০. থিওরি পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন টপিকের দ্বারা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে তার দায়-দায়িত্ব, নিয়ম-কানুন শেখাতে হবে।
১১. ড্রাইভারদের থিওরি পরীক্ষা হবে বুয়েটের এআরআই দ্বারা এবং বিআরটিএ প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে।
১২. কোনো রকম দেরি না করে হাসপাতালগুলোকে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ সংক্রান্ত একটি রুল হাইকোর্টে পর্যবেক্ষণে রয়েছে। পাশাপাশি এসব রোগীদের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত চিকিৎসা এবং আর্থিক দিকগুলো বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে ট্রমা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে।
১৩. ট্রিপপ্রতি বা দৈনিক ভিত্তিতে ড্রাইভার নিয়োগ পদ্ধতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাতিল করতে হবে।
১৪. ড্রাইভারদের বাস কোম্পানি মালিক কর্তৃক মাসিক বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
১৫. দুর্ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে ও বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধে রাজধানীতে বাস রুটগুলোকে ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিতে চলার পদ্ধতি চালু করতে হবে।
১৬. বৈধ লাইসেন্সের ভিত্তিতে একটি রুটে মাত্র একটি কোম্পানির বাস চলবে।
১৭. ফ্রাঞ্চাইজ পদ্ধতিটি হবে রুট বা শহরভিত্তিক। তাই প্রতিটি রুট ভিন্ন ভিন্ন রঙিন কোডের দ্বারা আলাদা করা থাকবে।
১৮. এই পদ্ধতিগুলোর ফলে যাত্রীদের আর্থিক সুবিধা হবে এবং বাস কোম্পানিগুলোর ড্রাইভারদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ হবে।
প্রতিবেদনটির আরেকটি অংশে বলা হয়েছে, রাজধানীতে মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৯০ লাখ। ২০১৮ সালের আগস্টের বিআরটিএ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীতে মোট যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১১ দশমিক ৭ লাখ। এর মধ্যে প্রাইভেট যানের সংখ্যা ৮ দশমিক ৬ লাখ, যা মোট যানবাহনের ৭৪ শতাংশ। আর পাবলিক যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। শহরের মধ্যে বাস রুট রয়েছে ৩০০টি। গড়ে একটি বাসে ১ হাজার ৫০০ মানুষ চলাচল করতে পারে। রাজধানীর প্রায় ৩ হাজার ৮০০ মানুষ এই ৫ হাজার ও ১১ দশমিক ৭ লাখ যানবাহনের মালিক।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/101346